আফগানিস্তানকে বুঝতে হলে পেছাতে হবে কিছু সময়।
আফগানিস্তানকে বলা হয় গ্রেভইয়ার্ড অফ এমপায়ার্স। অনেক সুপার পাওয়ার এসেছে, নাক কাটিয়ে চলে গেছে। কাজ শেষে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে দেশটাকে।
কিন্তু এমন না কেউ কনকিউর করেনি। আলেকজেন্ডার করেছিলো, আরব কিং, চেংগিস খান, শাহজাহান আর আওরঙ্গজেব এমনকি শিখ রাজা রনজিত সিং করেছিলো।
কিন্তু আফগান ওয়ারিয়রা, খুব সমস্যা তৈরি করতো তাদের ইনভেড করা রুলারদের জন্য।
আরেকটু সামনে এগোনো যাক।
১৮৩৮তে আফগান রাজা আমির দোস্ত মোহাম্মদকে সরিয়ে দেয় ব্রিটিশরা, সেখানে বসায় ব্রিটিশদের পাপেট রাজা শাহ সুজা দুররানিকে।
তখন আফগানিস্তানের কোন আর্মি ছিলো না। পুরো দেশটা ছোট ছোট ট্রাইবে বিভক্ত ছিলো। প্রত্যেক ট্রাইবের একজন চিফ থাকতো। সেই ট্রাইব চিফরা একত্রিত হলো, ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়লো। আধুনিক অস্ত্রপাতিতে সজ্জিত ব্রিটিশদের ঝেটিয়ে বিদায় করলো। মারা পড়লো আহমেদ সুজা, ট্রাইব চিফরা রাজা আমির দোস্তকে সিংহাসনে বসালো।
একে বলা হয় প্রথম এংলো-আফগান যুদ্ধ… যা হারে ব্রিটিশরাজ।
১৮৭৮ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত দ্বিতীয় এংলো-আফগান যুদ্ধ হয়। এতে হেরে যায় আফগানরা। কিন্তু ব্রিটিশরা পুরো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেনি এবার। প্রথম এংলো-আফগান যুদ্ধের হারের শিক্ষা বলা যেতে পারে।
১৮৯৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার ডুরান্ড লাইন দিয়ে আফগানিস্তান আর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মাঝে একটা দাগ টানা হয়। ব্রিটিশদের একটা ভয় ছিলো, রাশিয়া না আবার আফগানিস্তানে ঢুকে যায়! যদিও ১৯০৭ সালে রাশিয়ান এমপায়ার আফগানিস্তান ব্রিটিশদের এটা মেনে নেয়।
১৯১৯ সাল। শুরু হয় তৃতীয় এংলো-আফগান যুদ্ধ। একে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়। জিতে যায় আফগানরা, ব্রিটিশরাও স্বীকৃতি দেয় আফগানিস্তানকে।
রাজা আমানুল্লাহ খান এই যুদ্ধ জেতেন আফগানদের হয়ে, যিনি অনেক আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। তিনি পলিগ্যামিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর আগের রাজাদের হেরেম ছিলো স্ত্রীদের, কিন্ত রাজা আমানউল্লাহ খান বিয়ে করেন একটিই, যাকে তিনি ভালোবাসতেন। রানী সুরাইয়া তারজি। এই রাজা-রাণী মিলে বদলাতে শুরু করলেন আফগানিস্তানকে। তাঁরা বহুবিবাহের বিপক্ষে মত দিলেন, মেয়েদের জন্য স্কুল খুললেন, ইকুয়াল রাইটস মেয়েদের জন্য, এমনকি মহিলারা তাদের স্বামীকে তালাক দিতে পারার রাইটও পেলেন। ১৯২৬ সালে এই পদক্ষেপগুলোকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশই নেই।
কিন্তু তাদের পরিবর্তন ভালো চোখে দেখেনি কট্টরপন্থীরা। সরিয়ে দেয় তারা রাজা আমানউল্লাহ এবং রাণী সুরাইয়াকে। বলা হয় এর পেছনে ব্রিটিশদের হাত ছিলো। আফগানিস্তানের এত প্রোগ্রেসিভনেস তাদের ভয়ে ফেলেছিলো।
নাদির শাহ, তারপর তার ছেলে জহির শাহ ১৯৩৩ সালে রাজা হন দেশের। অস্বীকার করা যাবে না, তার সময়ে আফগানিস্তান উন্নতির শিখা দেখে চোখ ভরে। মর্ডানাইজ আফগানিস্তান এর ছবি তার আমলেরই।
আরও একটু সামনে আগাই। ১৯৭৩ সালে ক্যু হয়, জহির শাহ সরে যান। বসেন দাউদ খান, যিনি জহির শাহ-এর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
আফগানিস্তানে তখন কমুনিস্ট পার্টি ছিলো। এক সেনাঅভ্যুথানে মারা হয় দাউদ খানকে, ক্ষমতায় আসেন কমুনিস্ট চিন্তাচেতনার প্রেসিডেন্ট নুর মুহাম্মদ তারাকি। কিন্তু ১৯৭৯ সালে নুর মুহাম্মদ তারাকির অ্যাসাসিনেশন হয়, যা রাশিয়ার আফগানিস্তান দখলে আসার পথকে মসৃণ করে। আফগানিস্তানের কমুনিস্ট চিন্তা-চেতনা রক্ষার উদ্দেশ্যে তারা ঢোকে দেশটায়। আবার বেদখল হয় আফগানিস্তান।
মনে রাখতে হবে যে তখন চলছিলো কোল্ড ওয়ার আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের তেতো স্বাদ তখনও আমেরিকা ভোলেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তানে প্রবেশ কোনমতেই মানতে পারছিলো না আমেরিকা।
শুরু হলো সিআইএ’র ফান্ডিং। হাজার কোটি টাকার অস্ত্র তুলে দেয়া হচ্ছিলো মুজাহিদিনদের হাতে, যারা লড়ছিলো সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে।
সিআইএ অপারেট শুরু করে, নাম অপারেশন সাইক্লোন, সবচেয়ে বড় মিশন সিআইএর। কোল্ড ওয়ার জেতাই মূল কথা।
চার্লি উইলসন’স ওয়ার মুভিটি দেখা থাকলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার বুঝবেন। সিআইএর সাথে আইএসআই, ব্রিটিশ গোয়ান্দা সংস্থাও যোগ দেয় সোভিয়েত তাড়ানোর মিশনে। রোনাল্ড রিগ্যান তো মুজাহিদিনদের হোয়াইট হাউজে নিয়ে বৈঠকও করে। মুজাহিদিনদের হাতে আসে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল, কারণ সোভিয়েতদের কাছে ভয়ানক হেলিকপ্টার ছিলো।
১৯৮৯ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়া শুরু করে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভাঙনের মুখে।
মুজাহিদিনরা ক্ষমতায় আসে, নেতা হন বুরহাউদ্দিন রাব্বানি। কিন্তু না, ১৯৯৬ সালে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। কারা সরায়?
তালিবান।
তালিবান পশতু শব্দ, যার অর্থ ছাত্র। মোল্লা উমর ৫০ জন লোক নিয়ে তালিবান গ্রুপ বানায়। তালিবানদের পাকিস্তান আর সৌদি আরব সাপোর্ট দেয়। আর এটাও সত্যি যে, তালিবানদের জন্মের কিছু দায়িত্ব আমেরিকাকেও নিতে হবে।
শুরুতে তালিবানদের জনসমর্থন মেলে অনেক। কারন আফগানরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। আর বিদেশিদের ইনভেশন মেনে নেয়ার মুডে ছিলো না। তারা মেনে নেয় নতুন আমির মোল্লা ওমরকে। শুরুতে মনে হয়েছিলো সব ঠিকই চলবে।
কিন্তু শুরু হয় তালিবানদের এক্সট্রিমিজম। টিভি সিনেমা গান সব ব্যানড। ১০ বছরের ওপর মেয়েদের লেখাপড়া ব্যানড। মেয়েরা একা ঘর থেকে বের হতে পারবে ন, সাথে পুরুষ থাকা লাগবে। ছবি তোলা বিভিন্ন খেলাধুলা যেমন ফুটবল দাবা আরও কত কি সব ব্যানড করা হয়। অনেক প্রত্নতত্ব ধ্বংস করে তালিবানরা।
তারপর ২০০১, আল কায়েদা ৯/১১ ঘটায়। ওসামা বিন লাদেনকে জায়গা দেয় মোল্লাহ ওমর।
তারপর বাকি ঘটনা সবাই জানে। আমেরিকা দখল করে আফগানিস্তান। তারপর কত কি ঘটে গেলো।
এখন আমেরিকা চলে আসলো আফগানিস্তান ছেড়ে। ২০ বছর পর তারা বলছে এটা তাদের যুদ্ধ না!
তালিবান আজ আবার ব্যাক করেছে। অনেকে সমর্থন করছে, বলছে এনাফ অত্যাচার হয়েছে আমেরিকার, এনাফ ড্রোন স্টাইকে মারা হয়েছে নিরীহ মানুষ। অনেকে বলছেন, তালিবানদের ৯৬তেও মানুষ স্বাগত জানিয়েছিলো; শুধু মানুষ কেন, বড় দেশগুলোও মেনে নিয়েছিলো।
কিন্তু বাকিটা সময় বলে দেবে, দুঃখে ভরা দেশটার ভাগ্যে কী আছে সামনে। আফগানিস্তানের বিমানবন্দরে মানুষের ভীড় দেখে কিছুটা হলেও পালস বোঝা যায়। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা আফগানদের মর্মান্তিক। কিন্তু আমেরিকা তো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে সারাজীবন থাকবে না।
জিওপলিটিকস ডিপ্লোম্যাসি হাবিজাবি কচলাবো না, শুধু মনে হয় সবাই বিভিন্ন প্যাকেটে একি মোয়া বিক্রি করেছে দেশটায়। আমেরিকা ২০ বছর থেকে করলোটা কি যদি তালিবান থেকেই যায়? এত যুদ্ধ এত মৃত্যু, শেষ পর্যন্ত ফলাফল তো শূন্য!
দেশটির ভবিষ্যৎ কী হবে তা সময় বলে দেবে। তবে আমার মনে হয়, শুরুর কয়েক বছর খুব ভালো ভালো কাজকর্ম তালিবানরা করবে, এতে অনেক দেশ সমর্থনও দেবে, স্বাগত জানাবে।
তারপর? সেই পুরোনো প্যাকেটে নতুন মোয়া বিক্রি করতে আসবে কোন দেশ।
সমাধান? আফগানদেরই এর সমাধান করতে হবে। নিজেদের ভাগ্য নিজেদের নির্ধারণ করতে হবে। এক রাতের ভেতর হয়তো তা হবে না, কিন্তু বের হতে হবে এই চক্র থেকে, হোক তা তালিবান কিংবা বিদেশী পরাশক্তি।
পূর্ব পুরুষরা যেভাবে সব দখলদারদের ঝেটিয়ে তাড়িয়ে স্বাধীন হয়েছিলো, সেই পূর্বপুরুষদের মত হতে হবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন