ছেলেরা এমনই হয়।'
'মেয়েরা মুখে "না" বললেও মনে মনে তো এটাই চায়।'
'ধর্ষণের শিকার মেয়েটা তো নেশাগ্রস্ত ছিল।'
পুরো বিশ্বে কম-বেশি এমন সব ছুঁতোয় আড়াল হয়ে যায় ধর্ষকের অপরাধ। কাঠগড়ায় ধর্ষকের বদলে ওঠানো হয় ভিকটিমকে এবং তার দোষ বের করে ধর্ষকের কাজকে ন্যয্যতা প্রদান করা হয়। তারই সাথে আমাদের এই পক্ষপাতদুষ্টতা ধর্ষণচর্চার মূলকে আরো গভীরে নিয়ে একটু একটু করে শক্তিশালী করে তোলে। কিছু হিংস্র পশু নারীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ধর্ষণচর্চার যে বীজ বপন করেছে, তা আমরা সকলে মিলে সযত্নে বড় করে তুলছি প্রতিদিন। সবাইকে সমানভাবে সম্মান করার মাধ্যমে সমাজের ছোট ছোট ভুল ধারণা বদলে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা এই ধর্ষণচর্চা নির্মূলে সাহায্য করতে পারি। চলুন জেনে নিই, ধর্ষণচর্চার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ১৬টি উপায়।
১# 'কনসেন্ট' বা পূর্ণসম্মতি সম্পর্কে অবগত হওয়া
সম্মতি প্রদান করার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যৌনতার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের অনুমতি বা সম্মতি অবশ্যক। 'না' শব্দটি উচ্চারণ না করলেই যে তা হ্যাঁ হয়ে যায় তা কিন্তু নয়। এ ব্যাপারে যেকোনো পক্ষের মাঝে ক্ষুদ্র অনিশ্চয়তা থাকার অর্থই হল 'না'। নিজের জীবনে এই নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং এ বিষয়ে অন্যদের সাথে কথা বলতে হবে।
২# সমস্যার মূলে যেসব ছোট ছোট সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা
ধর্ষণচর্চা তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে, যখন থেকে আমরা পুরুষদের শক্তিশালী এবং নারীদের দুর্বল বলে মনে করি। এভাবে আমরা পুরুষতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিয়ে নারীদের ওপর কর্তৃত্বের সুযোগ করে দেই।
এছাড়াও, 'পোশাক ঠিক ছিল না', 'নেশাগ্রস্তদের পরিণতি এমনই হয়' ছুঁতো দিয়ে ভিকটিমের ওপরে দোষ চাপানোর যে প্রবণতা, তাও এই চর্চাকে আরো বেশি উসকে দেয়।
যৌন নির্যাতনের কারণ খুঁজতে গিয়ে নারীর পোশাকের দোষ না দিয়ে পুরুষরা কেন জবরদস্তি ও হিংস্রতার মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতা জাহির করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে।
৩# নিজের কাছে পুরুষত্বের সংজ্ঞা পরিষ্কার করা
নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার কাছে পুরুষত্বের অর্থ কী? পুরুষের মর্যাদা কি শুধুই ক্ষমতা, শক্তি বা কর্তৃত্বের মাঝেই নিহিত? কেন এসব বৈশিষ্ট্য দিয়েই শুধুমাত্র পুরুষত্ব জাহির করতে হবে? ক্ষমতাবান, শক্তিশালী না হলে কোনোভাবে যে আপনি কম পুরুষ হয়ে যাবেন না, এই উপলব্ধিটা খুবই জরুরি। কষ্ট পেলে, কাঁদলে বা তথাকথিত 'নারীদের কাজে সাহায্য' করলেও আপনি পুরুষই থাকবেন। এই উপলব্ধির মাধ্যমে, এগুলো নিয়ে নিজেদের মাঝে কথা বলে বা লিখে এবং আর্টের মধ্যে দিয়ে পুরুষত্বের সত্যিকার অর্থের চিত্র তুলে ধরে অন্যদেরও বোঝাতে সাহায্য করতে হবে।
৪# যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীর দোষ খোঁজা বন্ধ করতে হবে
আমাদের অজান্তেই আমরা অনেক কথায় ধর্ষণচর্চাকে সমর্থন দিয়ে ফেলি। 'খোলামেলা পোশাক পরলে তো অমন হবেই, যা চেয়েছে তাই হয়েছে', এমন দোষারোপের আড়ালে চাপা পড়ে যায় ধর্ষকের অপরাধ। 'I know you want it', 'She'e asking for it' ইত্যাদি পশ্চিমা গানের কথার মধ্যে দিয়ে এসব দোষারোপও স্বাভাবিক হয়ে যায়। এভাবে পপ কালচারে নারীকে ছোট করে এবং তাদের বিভিন্ন বাজে নামে ডেকে এসব বিষয়কে স্বাভাবিক করে ফেলা হচ্ছে। আপনি কি এসব ভাষা এবং লিরিক্স ব্যবহার করবেন কি না, তা আপনার উপরেই নির্ভর করছে। নারীর পোশাক, মদ্যপান করে কিনা, সে কোথায় কোন সময়ে আছে, এসব কখনোই কাউকে তাকে ধর্ষণ করার অনুমতি বা অধিকার দেয় না।
৫# 'জিরো টলারেন্স' পলিসি
আপনার বাড়ি, এলাকা, অফিস বা সংগঠনে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পলিসি বজায় রাখুন। অর্থাৎ যৌন হয়রানি করা ব্যক্তিকে অফিস বা সমাজ থেকে বিতাড়িত করুন এবং নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলুন।
৬# ধর্ষণচর্চার নানা দিক সম্পর্কে জানা
যুগের পরিবর্তনে যৌন নির্যাতন এবং তার শিকার হওয়া ব্যক্তিদেরও পরিবর্তন ঘটছে। রাতের বেলা খোলামেলা পোশাক পরা মেয়েটিই শুধু এখন ধর্ষিত হচ্ছে না। আর ধর্ষণও শুধু রাস্তার বখাটে, গুণ্ডা ছেলেপেলেরা করছে না। এছাড়াও বাল্যবিবাহ এবং সাধারণ বৈবাহিক সম্পর্কের আড়ালেও লুকিয়ে আছে জবরদস্তি করে যৌন কামনা পূরণ করার গল্প।
এছাড়াও ধর্ষণকে কেউ সমর্থন না করলেও 'অন্তত ধর্ষণ তো হয়নি' এমন কথা বলে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের ভয়ানক অভিজ্ঞতাগুলোকে ছোট করে দেখেন। আমাদের এসব 'ছোট ছোট' বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে এবং অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
৭# সকল ধরনের ‘মানুষের’ কথা চিন্তা করা
আমরা যেকোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা বয়সেরই হয়ে থাকতে পারি এবং ধর্ষণ আমাদের সকলকেই কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে ও করবে। আমরা ধর্ষণের বীজ গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে পারলে যেকোনো লিঙ্গ বা সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের ব্যক্তিই নিরাপদ থাকতে পারবে৷
নারী ছাড়াও LGBTQI'র কমিউনিটির ব্যক্তিরাও নানাভাবে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। এমনকি পুরুষরাও পুরুষদের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে থাকে।
LGBTQI কমিউনিটির বহু সদস্যকে হয়রানির শিকার হতে হয়, যেখানে অপরাধী দাবি করে যে তার সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে তার সমকামিতার 'সমস্যা’ ঠিক হয়ে যাবে। এসব সম্পর্কে আমাদের আরো জানতে হবে এবং তাদের সাহায্য করতে হবে।
৮# ধর্ষণচর্চার ইতিহাস জানা
ইতিহাসের সকল যুদ্ধে নারীদের উপর নির্যাতন এবং ধর্ষণ সবসময়ই খুব বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে এসেছে। গণহত্যা কিংবা জাতি নির্মূল করার প্রচেষ্টায় বারংবার নারীদের করা হয়েছে লাঞ্ছিত। এ সম্পর্কে জানতে খুব দূরের ইতিহাস ঘাটতে হবে না। সাম্প্রতিক কিছু দ্বন্দ্ব যেমন, কসোভো দ্বন্দ্ব, গুয়েতেমালা যুদ্ধ ইত্যাদির দিকে তাকালেই দেখা যাবে নারীদের ওপর অমানবিক লাঞ্ছনার চিত্র।
৯# নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিনিয়োগ
নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার, সমকামিদের সহযোগিতায় কাজ করে এমন সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দিন। এর মাধ্যমে আপনিও এসব উদ্যোগের অংশ হতে পারবেন।
১০# ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তির অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করা
#MeToo, #TimesUp, #NiUnaMenos, #BalanceTonPorc ইত্যাদি অনলাইন মুভমেন্টের সময় নারীদের যৌন হয়রানি এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের যেসব কাহিনী উঠে এসেছে সেসব সম্পর্কে পড়ুন, জানুন এবং শুনুন। তাদের ভয়ানক অভিজ্ঞতা, এসবকে পিছে ফেলেও তাদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প, সারা বিশ্বের বিভিন্ন অ্যাকটিভিস্টদের কাজ সম্পর্কে খোঁজ নিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #OrangeTheWorld এবং #GenerationEquality ফলো করুন।
এসব জানুন এবং বলুন যে, 'আমিও আছি তোমার পাশে।'
১১# ধর্ষণ নিয়ে রসিকতা অগ্রহণযোগ্য
আপনার রসবোধ বোঝাতে আপনি ধর্ষণ সংক্রান্ত রসিকতা বেছে নিলে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানি নিয়ে কোনো ধরনের রসিকতা করা অথবা সহ্য করা উচিত নয়। এতে এর শিকার হওয়া নারীদের জন্য এসব নিয়ে কথা বলা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
১২# প্রসাশনকে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করা
বিশ্বের নানা দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই বলে ধর্ষকেরা পার পেয়ে যায় কিংবা আরো লাই পেয়ে যায়। সম্পত্তির মালিকানা, বিবাহবিচ্ছেদ এবং এর পর সন্তানের অভিভাবকত্ব, ধর্ষণের সঠিক বিচার না হওয়া ইত্যাদি ছাড়াও নানারকম নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইনের নিদর্শন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। আপনার প্রসাশন কী করছে আপনার দেশে নারী নিরাপত্তার জন্য সে বিষোয়ে জানুন এখানে- http://evaw-global-database.unwomen.org/en
প্রশাসনকে বাধ্য করুন সঠিক আইন প্রয়োগ করে নারী নিরাপত্তা এবং সমঅধিকার নিশ্চিত করতে।
১৩# ‘ইম্পিউনিটি’ বা অপরাধের দায়মুক্তির সমাপ্তি
ক্ষমতার রাজনীতিতে লেগে থাকার বড় লাভ হল ইম্পিউনিটি।
'কে আমার কী করতে পারে দেখি'- সরকারে থাকা দলের কর্মীদের এবং ছাত্রদের এই মনোভাব তাদের ছাত্র বা কর্মী থেকে পরিণত করে গুণ্ডা, ধর্ষক বা ডাকাতে। দলের ক্ষমতা এবং নেতাদের হাত মাথার ওপরে থাকায় তারা যা খুশি করে যেতে পারে। ফলাফল সুবিচারের অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রাজনৈতিক শক্তির বশ্যতা ইত্যাদি। আমাদের এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে এবং সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিতে হবে।
১৪# যেকোনো ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া
প্রতি তিনজনে একজন নারী যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হন। মাঠে-ঘাটে, বাসে-রাস্তায় যৌন হয়রানির ঘটনা এত বেশি ঘটে যে, অনেক সময় আমরাও এসবের সাক্ষী হয়ে যাই। আমাদের উচিত এমন কিছু সামনে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকে বাঁধা দেওয়া এবং তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া।
এ ধরণের ঘটনার মুখোমুখি হলে প্রথমত বোঝার চেষ্টা করুন কী ধরণের সাহায্য দরকার বা আপনি কী করতে পারবেন৷ এমন ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে আপনার এই এগিয়ে আসা ভীষণভাবে সাহায্য করবে। কোনোভাবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বা অপরাধীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে গিয়েও আপনি সহায়তা করতে পারেন।
১৫# আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত করা
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও যেন এসব ভুল ধারণা নিয়ে বড় না হয় তার দায়িত্ব আমাদেরই৷ নারী-পুরুষ ছাড়াও যে অন্য লিঙ্গ থাকতে পারে বা নিজের লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ যে ভুল কিছু নয় তা ছোটদের জানাতে হবে। সন্তানরা যেন নিজেদের সকল মনোভাব প্রকাশ করতে পারে সে সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের ভুল ধারণাকে শুধরে দিতে হবে। সম্মতি সম্পর্কে শেখাতে হবে কিশোর বয়স থেকে।
১৬# এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করা বা আলোচনার অংশ হওয়া
পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সাথে আলোচনা করুন কিভাবে ধর্ষণের এই ভয়ানক চর্চা বন্ধ করতে পারেন এবং নারীদের সাহায্য করতে পারেন। নারীবাদিদের সমর্থন করুন। পুরুষত্বের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে নারী ক্ষমতায়নের জন্য আর্থিক সহায়তা, যেকোনো ধরনের আলোচনায় নিজেকে সংযুক্ত করুন এবং অন্যদের ভুল মতামত পাল্টাতে সাহায্য করুন। শুধু আমি বা আপনি নয়, হাজার হাজার মানুষের ভুল ধারণা পাল্টাতে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। একসাথে মিলে রুখে দাড়াতে হবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন