২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় বইমেলায় একদিন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেবার বইমেলাটা একটু অন্যরকম ছিল। মেলায় আমার দুটো বই প্রকাশিত হলেও গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে আমি প্রায় অচ্ছ্যুৎ হয়ে পড়েছিলাম। প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিকরা আমাকে এড়িয়ে চলতেন। আমি স্বভাবসুলভ পরিহাসমূলক কোনো সম্বোধন করে কারও দিকে এগিয়ে গেলেও চোখ রাঙিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গি তৈরি করতেন তারা। ওই সময় ফারুকীর সঙ্গে একদিন দেখা হলো। তখন বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে হতো। মেলা থেকে বেরিয়ে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ডিম পরোটা খেলাম। তখন ফারুকী তার দুঃখের কথা বললেন। ওই সময় তিনি টেলিভিশন সিনেমাটি রিলিজ দিয়েছেন। আন্দোলনের কারণে সিনেমাটি ব্যাপকভাবে মার খেয়ে যায়। ফারুকী আমাকে বলেন, তার বিদেশি বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করছেন, এই আন্দোলন আসলে কী নিয়ে? তিনি যখন তাদেরকে বলেছেন, এই আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তখন তার বিদেশি বন্ধুরা তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো চলছে। তাহলে আন্দোলন কী নিয়ে? তিনি যখন উত্তর দিয়েছেন, এই আন্দোলন মূলত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে সংগঠিত হয়েছে। তখন বিদেশীরা তাকে প্রশ্ন করেছেন এরকম দাবি কি কোনো সভ্য দেশে উঠতে পারে? শহুরে শিক্ষিত একটি জনগোষ্ঠী শহরের কেন্দ্রে সংগঠিত হয়ে ফাঁসির দাবিতে একত্রিত হতে পারে?
ফারুকী ঐদিন আমাকে বলেছিলেন, তিনিও তার বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে একমত।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শেষ হওয়ার পর যখন ফরহাদ মজহারকে ঢাকার শিল্পী সাহিত্যিক মহল প্রায় এক ঘরে করে দিল, তখন একদিন কবি আলমগীর নিষাদ আমার কাছে এলেন। বললেন, ফরহাদ ভাইকে রেসকিউ করতে হবে। টাঙ্গাইলে আমরা একটি সাহিত্য সভা করব সেখানে আমি যাব কিনা। আমি বললাম, অবশ্যই যাব। শুনে নিষাদ খুব বিস্মিত হলেন। বললেন, আমার আগে তিনি অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবাই তাকে মানা করে দিয়েছেন। সেবার, আমি, নূরুল আলম আতিক, সালাহউদ্দিন শুভ্র, মোহাম্মদ আজম সহ বেশ কয়েকজন টাঙ্গাইলে গিয়েছিলাম। পরে আমরা যখন ওই সাহিত্য সভা ঢাকায় নতুন করে সংগঠিত করতে যায় তখন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমাদের সঙ্গে যোগ দেন।
দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সুবাদে আমি এটা ভালো করেই জানি, আমাদের গুটিকয় বন্ধুর মতো ফারুকী কখনোই তার মুসলিম পরিচয়কে আড়াল করার চেষ্টা করেননি। আমরা যেমন সাহিত্যের মাধ্যমে কলকাতার হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করে এসেছি, তেমনিভাবে ফারুকীও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কলকাতার হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করে এসেছেন।
কিন্তু নানাভাবে আওয়ামী রেজিম তাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। একের পর এক সিনেমা আটকে যাচ্ছিল। তাকে নানাভাবে কাবু করার চেষ্টা করছিল তারা।
আমরা যখন ভোটাধিকার ও মত প্রকাশের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন শুরু করি, তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী বিরোধী শিবিরে লেখক শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক শিক্ষকদের একটি উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নিশ্চিত করা। আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছিলাম, বহু মানুষ আওয়ামী শাসনের প্রতি তিতিবিরক্ত হয়ে পড়লেও তারা একত্রিত হতে পারছেন না। ফলে, আওয়ামী বিরোধী সেক্যুলার স্পেসগুলোতে আমরা কাজ করতে শুরু করি। তাতে বেশ খানিকটা সফল হই। আমাদের এইসব আন্দোলনেও নেপথ্যে থেকে সমর্থন দিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
বিভিন্ন বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। ফেসবুকে লিখে আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নানাভাবে এই আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করেছেন।
কিন্তু এখন সমস্যা হলো, এখন সবাই মোটাদাগে সবকিছু বিচার করার চেষ্টা করছে। আমরা যারা মাঠে থেকে আন্দোলন করেছি, তাদের হয়ত অস্বীকার করতে পারছে না, কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের সূক্ষ্ম কাজগুলো অনায়াসে বাতিল করার একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও এই বাতিলবাদের শিকার। আমরা আওয়ামী বিরোধী সকল মতের সম্মিলনের কথা বলছি। কিন্তু বাস্তবে বাতিলবাদে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। এগুলো আমাদের কোথাও নেবে না।
আজ বন্ধু মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাতে আমি চিন্তিত। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে আমরা যে নতুন মেরুকরণ ঘটাতে পেরেছি তা কিছু অবিমৃশ্যকারীর প্রচেষ্টায় প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে। এই বিভাজন আওয়ামীপন্থী রাজনীতিকে জোরদার করে তুলবে মাত্র। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য জগত থেকে খুব সহজে আবার আওয়ামীলীগের পুনরুত্থান ঘটতে সহায়তা করবে। এই পুনরুত্থানকে উদযাপন করবে আওয়ামীপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলো। যারা এই জটিল রাজনীতিটা বুঝতে পারছেন না, তাদের হয়ত নতুন করে বোঝানোর সময় আমরা পাব না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন