সেই দুষ্টু শিশুটির গল্প জানা আছে নিশ্চয়ই। অসুখ হয়েছে কিন্তু কিছুতেই সে তেতো ট্যাবলেট খাবে না। তার পছন্দের খাওয়া রসগোল্লা। মা পরে চালাকি করে এক হাড়ি রসগোল্লা কিনে তার সবগুলোর ভেতর একটা করে ট্যাবলেট ঢুকিয়ে রাখল। দুষ্টু শিশু প্রতিদিন দুটো করে রসগোল্লা খায়। সে মহা খুশী, সাথে তার মা ও খুশী। পরে অসুখ ভালো হচ্ছেনা দেখে একদিন পুত্রকে জিজ্ঞেস করেন, বাবা রসগোল্লা খেয়েছ? ছেলে ফোকলা দাতে ফিচেল হাসি দিয়ে বলে, রসগোল্লা খেয়েছি কিন্তু রসগোল্লার ভেতরের বীচি ফেলে দিয়েছি। যে দেশের বুড়ো বুদ্ধিজীবীরা দেশের প্রথম সারির পত্রিকায় 'বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাইনা' ঘরানার বিষ্ঠা প্রসব করেন সেই দেশের শিশুরা খালি রসগোল্লা চাইবে, তার বীচি চাইবে না এটাই তো স্বাভাবিক।
ঠিক যেমন করে আমরা নারী চাই, নারীবাদিতা চাই না। বালেগ হবার পর আমাদের অনেকে এ ধরণের কল্পনা করত। আহা, কতই না ভালো হতো 'মেয়েমানুষ' যদি বোবা হতো। দেখতে পরীর মতো সুন্দরী হবে, চোখের ইশারায় কথা বলবে। পুরুষ কথা বলবে, চোখ বড়বড় করে নারী সেই কথা শুনবে। পুরুষ বসে বসে পত্রিকা পড়বে, নারী পা টিপে টিপে এসে একটু খুনশুটি করে এক পেয়ালা চা দিয়ে যাবে। মন ভালো হলে নারী মিষ্টি করে হাসবে, একটু অভিমান হলে চোখের পাতা ভিজে যাবে। আহা, একেবারে আদর্শ নারীর মডেল। পুরো মডেল ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায় যখন 'মেয়েমানুষ' মুখ খুলে। যখন তারা নিজেদের সমান অধিকার চাওয়া শুরু করে। তখন নারী আর নারী থাকে না, নারীবাদী হয়ে যায়। শুরু হয় রসগোল্লার তেতো বীচির উৎপাত। মুখে বলতে বড়ই শরম লাগে কিন্তু মনে মনে অনেকেই বিজ্ঞানকে চায় সেই আদর্শ নারীর মতো করে! যে কিনা বাতাস দিবে, খাওয়া দিবে, আরাম আয়েশ সেবাযত্ন দিবে, কিন্তু সবই করবে মুখ বন্ধ রেখে।
আমরা তাই নিউটন চাই, আইনস্টাইন চাই, এডিসন চাই, ডারউইন চাই না। নিউটন, আইনস্টাইন দিলে সূত্র, তত্ত্ব আর ডারউইন দিলে সেটা পাগলের প্রলাপ। ধর্ম আর জিরাফ মিলিয়ে সেই প্রলাপকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। কোন গাইগুই না করে মহাকর্ষ, অভিকর্ষ, থার্মোডিনামিক্সের থার্ড ল সবই মেনে নেয়া হয়। বিবর্তন আসলে, হে হে আপনে বান্দর থেকে আসতে পারেন আমি আদম থেকে আসছি বলে গান শুরু। আমরা মার্ক জাকারবার্গ চাই, স্টিভ জবস চাই, বিল গেটস চাই, কিন্তু স্টিফেন হকিং এ এসে হালকা চুলকানি শুরু হয়ে যায়। বিজ্ঞানকে আমরা রসগোল্লার মত করে চাই, তার ভেতরের তেতো বীচি চাইনা। চুপচাপ বসে বাপুরা বিজ্ঞান দিয়ে ফেসবুক বানাও, মোবাইল বানাও, কম্পিউটার বানাও কিন্তু এইসব বিগ ব্যাং ট্যাং বলে প্যাঁচ খেলার মানে কি? প্রতিবার প্যাঁচালো বিজ্ঞানীরা একটা করে প্যাঁচ খেলবে আর আমাদের পবিত্র গ্রন্থের চিপাচুপা খুঁজে প্রমাণ করতে হবে 'সকলই ব্যাদে আছে'। মহা ঝামেলার কাজ।
স্টিভ জবসকে নিয়ে মানুষের চুলকানি নেই, তবে স্টিফেন হকিং কে নিয়ে আছে। এডিসনকে নিয়ে কারো সমস্যা নেই, ডারউইনকে নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। কিন্তু বিজ্ঞান তো ধর্ম বা সমাজের চাকর নয়, বেতন ভুক্ত কর্মচারী নয়। মানুষের আরাম আয়েশের জন্য বিজ্ঞান যেমন এটা সেটা আবিষ্কার করে সবাইকে খুশী করে দেয়। তেমনি আদম হাওয়ার গল্প চোখ বুজে মেনে না নিয়ে সে 'আমরা কে, কোথা থেকে এলাম' এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে সে। এমনিতে বিজ্ঞান বেশ নিরীহ লোক। অত আইন কানুন হালাল হারামের প্যাঁচ খেলেনা। খেললে আমাদের খবর ছিল! ধর্মে আমাদের কারো জন্য শুয়োর, কারো জন্য গরু হারাম করা হয়েছে। শুয়োর বা গরুর একটা না খেলে কি আর আসে যায় তেমন? কিন্তু যদি একই রকম হালাল হারামের প্যাঁচ বিজ্ঞান খেলা শুরু করতো? ধরা যাক যদি একদল বিজ্ঞানী মিলে তাদের অনুসারীদের জন্য আজকে গুগল হারাম করে দিত! এক গ্রুপের লোকদের জন্য বিং হালাল, অন্য ধর্মের জন্য ইয়াহু হালাল, গুগল সবার জন্য হারাম। কেলেঙ্কারি ব্যাপার হয়ে যেত। তারচেয়েও বড় কেলেঙ্কারি হত যদি খালি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারকে একমাত্র হালাল ব্রাউজার ঘোষণা দিয়ে বাকি সব ক্রোম, ফক্সদের হারাম বলা হত। রীতিমতো সভ্যতাই ধ্বংস হয়ে যেত কয়দিনের মধ্যে!
সে যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে আমরা গুগল চাই, ফেসবুক চাই, সেলফোন চাই, ডাক্তার চাই, উড়োজাহাজ চাই কিন্তু বিজ্ঞানের পকপকানি চাইনা। আমার এক জ্ঞানী বন্ধু দিনরাত কষে গবেষণা করে। এই আজকে ন্যানো নিয়ে তো কালকে কোয়ান্টাম নিয়ে তো পরশু স্ট্রিং নিয়ে। দিনরাত নেচার আর সায়েন্সের আর্টিকেল পড়ে, উঠতে বসতে সেখান থেকে রেফারেন্স দেয়। আমেরিকায় এলজিবিটি রাইট পাশ হয়ে যাবার পর আমি একদিন প্রোফাইলে রঙধনু মারতেই দেখি ক্ষেপে গেল। আমি কাঁচুমাচু হয়ে, সমস্যা কি জিজ্ঞেস করা মাত্র হড়বড় করে সদম, গোমরাহ আর লুত নবীর কাছে চলে গেল। এইসব আকাম করায় নাকি ওইসব কোন কোন নগরী কিভাবে কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল সেই নিয়ে ছোটোখাটো লেকচার মেরে দিল। আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, দিনরাত যে নেচার আর সায়েন্স পড়ে তার কি সুবিধা মতো এইভাবে কি লুত নবীর কোলে বসে পড়া ঠিক? দুই একটা মেডিক্যাল জার্নাল ঘেঁটে কি একটু দেখা যায়, সমকামিতা কি জিনিস, এটা কেন হয়, হইলে কি হয়। দুই একটা সমাজবিজ্ঞানের পেপার টেপার পড়ে কি একটু দেখা যায় সমকামিতা আর সমকামীর অধিকার দুইটার মাঝে তফাৎ কি। সমকামিতাকে পছন্দ বা অপছন্দ কিছু না করেও এর অধিকার নিয়ে কথা বলায় কিনা। দুই এক কথার পরেই আমার জ্ঞানী বন্ধু ক্ষেপে গিয়ে বলে, তোর মন চাইলে তোর পশ্চাৎদেশ বিলায়ে দে, আমি এর মধ্যে নাই। আমরা লেসবিয়ান পর্ন চাই, সমকামীর অধিকার চাই না। পাড়ার ভিডিও সিডির দোকানের মালিকের সাথে বেশ খাতির ছিল। মাঝেমাঝে তার কাছ থেকে দুষ্ট-মিষ্ট সিনেমার সিডি নেয়া ছাড়াও মাঝেমাঝে তার সাথে বেশ আড্ডা দেয়া হতো। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, মামা সবচেয়ে চালু আইটেম কি? বলে, লেসবিয়ান পর্ন। গুগলে কিছুক্ষণ মোস্ট পপুলার পর্ন টাইপ লিখে খোঁজাখুঁজি করলাম। নানা দেশের নানা বয়সের লোকের নানা কিছু পছন্দ, কিন্তু অনেকগুলো তালিকার শীর্ষেই আছে লেসবিয়ান পর্ন। সেই সাথে এও উল্লেখ করা আছে এ ধরণের পর্নের শতকরা নিরানব্বই ভাগ গ্রাহকই পুরুষ, তাও আবার সমকামী পুরুষ নয়। তথাকথিত সুস্থ সবল সাধারণ পুরুষ! লুকিয়ে লুকিয়ে সমকাম দেখতে বেশ লাগে কিন্তু যখন সমপ্রেমিরা সামনে এগিয়ে এসে তাদের অধিকার দাবী করে তখন ওরে সমাজ গেল রে, ওরে আমার পুটু গেল রে বলে আর্ত চিৎকার শুরু।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেক পাঠক হয়তো ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, 'শালা রসগোল্লা দেখিয়ে বিজ্ঞান দিয়ে শুরু করে সমকামিতায় এসে থামলো। মতলবটা কি?' মতলব আসলে সমকামিতা নিয়েই কথা বলা। আগে হালকা টক মিষ্টি প্যাঁচাল দিয়ে শুরু করে তেতো গেলানোই উদ্দেশ্য। দেখুন আপনি হয়তো অনেক কিছু বুঝেন, আবার অনেক কিছু হয়তো বুঝেন না। আপনি হয়তো ফুরিয়ার ট্রান্সফরমেশন বুঝেন না, গেম থিউরি বুঝেন না, মাইটোসিস আর মিয়োসিস বুঝেন না। একইভাবে আপনি হয়তো সমকামিতা কি এবং কেন, সেটা কি আদৌ রোগ নাকি প্রাকৃতিক ব্যাপার সেটাও বুঝেন না। রসগোল্লার সেই তেতো বীচিখানাকে বুঝতেও চান না। না বুঝেই, এ সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা না করেই গলার রগ ফুলিয়ে তর্কের মাঠে নেমে যান। আবার অনেকে দাবী করেন তারা বেশ সায়েন্স টায়েন্স জেনে বিস্তর পড়াশোনা করেই জেনেছেন সমকামিতা আসলে একটি রোগ। কোন সমস্যা নেই। আপনার সেই জানাটা আমাদেরকে জানান। অভিজিৎ রায় যেরকম সমকামিতা নিয়ে আস্ত একটি বই লিখে নানা তথ্য উপাত্ত দিয়েছেন, আপনিও তেমনি বই লিখুন, জার্নালে ছাপান। পারলে সমকামিতা রোগের জন্য দুই একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও বানিয়ে সেই রোগের উপশম ঘটানোর চেষ্টা করুন। যদি মানুষ আপনার যুক্তি মেনে আপনার কাছে চিকিৎসা নিতে আসে তবে তাকে সাহায্য করুন। বলুন, তিন বেলা আধখানা করে প্যারাসিটামল কুসুম গরম পানিতে গুলে খাইলে এ রোগের সামান্য উপশম হয়। কিন্তু যদি কেউ বলে, আমি তোমার কথায় যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি সমকামী হয়েই থাকতে চাই, তখন তার পিছনে চাপাতি নিয়ে দৌড় দেয়ার তো মানে নেই।
সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ নাকি না এসব নিয়ে নানা লেখালেখি হয়েছে। সেই সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। যারা আগ্রহী তারা অভিজিৎ রায় এর কয়েকটি লেখা পড়ে দেখতে পারেন। সামান্য কিছু পড়াশোনা করে আমি নিজে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি তা হল, না সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। সেই সাথে এটিকে মেনে নেয়ার একমাত্র কারণ 'এটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়' এটাও না! এটি কোন রোগ নয় যে চিকিৎসার মাধ্যমে সেটা সারানো সম্ভব বা দরকার। আপনি কোন সিদ্ধান্তে আসবেন সেটা আপনার বিষয়। মানুষ কেন সমকামী হত সেটা বোঝা একটু জটিল মনে হলেও সমকামী মানুষের অধিকার খুব সহজ একটি জিনিস। বুঝতে চাইলে খুব সহজে বুঝে ফেলা সম্ভব। না বুঝতে চাইলে হাজার বলেও বোঝানো সম্ভব না হয়তো। মানুষের খুব অল্প কিছু অংশ সমকামী, শতকরা দশভাগেরও কম। সেই মানুষগুলা নিজের মতো করে থাকতে চায়, বাকি সব মানুষের মতো সকল মৌলিক অধিকার চায়। এটা কোন ভাইরাস না, কোন ছোঁয়াচে রোগ না। সমকামীদের সংস্পর্শে এসে কেউ সমকামী হয় না। লেসবিয়ান বা গে পর্ন দেখেও কেউ সমকামী হয় না। যারা হবার প্রকৃতির নিয়মে এমনে এমনেই হয়। নিশ্চিত থাকুন তারা এসে আপনার দিকে কু নজর দিবে না বা আপনার কানের কাছে এসে আপনাকে সমকামী হয়ে যাবার জন্য ঘ্যানঘ্যান করবে না। এটা কোন ধর্ম না, যে দলে দলে তাতে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানাবে সমকামীরা। তারা শুধু নিশ্চয়তা চায় সমাজে স্বাভাবিক ভাবে চলার। সেই নিশ্চয়তা কখনো তারা পায়নি বরং যুগযুগ ধরে নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে এসেছে। কম্পিউটারের জনক অ্যালান টুরিং থেকে শুরু করে নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষকে সমকামী হবার জন্য নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কাউকে কুপিয়ে মারা হয়েছে, কাউকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কাউকে রাষ্ট্র তার আইনে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, কেউবা নিজেই আত্মহত্যা করেছে সমাজের চাপ সহ্য না করতে পেরে। সদম ও গোমরাহ শহরকে কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল সমকামিতার জন্য সেটা পড়ে আপনি আতঙ্কে শিউরে উঠতে পারেন, সমকামিতা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কিন্তু আপনি যেরকম হনুমান লেজে আগুন লাগিয়ে অর্ধেক লঙ্কা ধ্বংস করে ফেলেছিল এটাকে বিশ্বাস করেন না, গালগল্প বলে উড়িয়ে দেন। তেমনি পৃথিবীর বড় একদল মানুষ সদম ও গোমরাহ শহরের ঘটনাকে গল্প বলেই মনে করেন, বিশ্বাস করেন না। তাই তাদেরকে লুত নবীর কথা বলে ভয় দেখানোর মানে নেই। এরপর বাকি রইল প্রকৃতি ও বিজ্ঞান। সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিনা বা বিজ্ঞান একে রোগ মনে কিনা এ বিষয়ে ভুরি ভুরি তথ্য উপাত্ত দেয়া আছে চারিদিকে। সেগুলো পড়ে কোন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর দায় দায়িত্ব আপনার। আমার নিজের সিদ্ধান্ত তো আগেই বললাম। না এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ না, বিজ্ঞান একে রোগ বলে মনে করে না। বরং হোমোফবিয়া অর্থাৎ সমকামীদের অচ্ছুৎ মনে হওয়াটাকে একটা রোগ বলে মনে করেন অনেকেই।
এখন এত কথা বলার পর ধরা যাক একশ লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, এবার বলুন সমকামিতা বিষয়ে আপনার মত কি। উত্তরে হয়তো পঞ্চাশ জন বলল, না এটা কোন রোগ নয় আর পঞ্চাশ জন বলল, এটা একটা রোগ, এটা একটা বিকৃতি। দ্বিতীয় অংশকে এবার হয়তো জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা মানলাম এটা একটা বিকৃতি এবারে এ বিষয়ে আপনার করনীয় কি? পঞ্চাশ জনের মাঝে বিশ জন হয়তো বলল, আই ডোন্ট কেয়ার, ওদের বিকৃতি নিয়ে ওরা থাকুক। আমি নেই বাপু এর সামনে পিছে। এবারে যাবো বাকি ত্রিশ জনের কাছে, তারা হয়তো বলল না এই বিকৃতি মেনে নেয়া যায়না, এর বিরুদ্ধে কিছু করা দরকার। জিজ্ঞেস করবো, কি করতে চান? উত্তরে হয়তো বিশজন বলবে, আমি তথ্য প্রমাণ বিজ্ঞান দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে যাবো এটা বিকৃতি। এটা করা ঠিক নয়। আর বাকি দশজন বলবে, অত বোঝানোর কিছু নেই। সমকামীরা সমাজের জন্য ভাইরাস। এই ভাইরাসকে মেরে কেটে যেভাবে হোক নির্মূল করতে হবে। সমকামীদের অধিকার ও নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা দরকার? এই শেষের দশজন মানুষের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্যই তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। সমাজের এই দশভাগ মানুষ সমকামিতার নাম শুনলেই উত্তেজিত হয়ে যায় এবং সমাজ রক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। এই দশজন মানুষ মিলে যুগে যুগে সমকামীদের নানাভাবে নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে। এখনও করে যাচ্ছে। আর বাকি নব্বই জন বসে বাঁশি বাজিয়েছে। এই মানুষগুলোর হাত থেকে সমকামী মানুষদের রক্ষা করার জন্য তাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরী।
সবশেষে কুতর্ক এড়ানোর জন্য কয়েকটি প্রশ্ন তুলে দিচ্ছি, যেগুলো তুলে ত্যানা প্যাঁচানোর কোন মানে নেই। সমকামিতা বিষয়ে কথা উঠলকেই এই প্রশ্নের ডালি নিয়ে একদল এসে হাজির হয়। এবং এর বেশিরভাগেরই উত্তর অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্যরা দিয়েছেন তার বিভিন্ন লেখায়। আপনার যদি সত্যি জানার উৎসাহ থাকে তবে সামান্য একটু কষ্ট করে সেগুলো খুঁজে খুঁজে পড়ে নিন।
১। সমকাম সমর্থন করেন তাহলে কি আপনি শিশুকামও সমর্থন করেন? (হে হে হে হে, আমি জানতাম আপনার মাথায় এই প্রশ্নটিই আসবে প্রথমে। খবিশ কুথাকার!)
২। সমকাম সমর্থন করেন তাহলে কি আপনি ধর্ষকামও সমর্থন করেন? (হে হে হে হে, এইটা অবশ্যই দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে।)
৩। সমকাম সমর্থন করেন, তাহলে কি আপনি পশু কামও সমর্থন করেন? (হে হে হে হে। এর উত্তর বরং দিয়ে দেই। নাহ, আমি করিনা। তবে আপনি যদি করতে চান আমার আপত্তি নেই। শুধু মনে রাখবেন আপনাকে পশুটির মৌখিক বা লিখিত অনুমতি নিতে হবে। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি আপনি ধীর পায়ে আপনার পোষা ছাগলটির দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলছেন, আই লাবু, ডু ইউ লাব মি? উত্তরে সে বলছে ... ম্যাএএএএ। আপনার চোখের কোনে জল ...)
৪। সমকাম সমর্থন করেন তবে কি আপনি ইনসেস্টও সমর্থন করেন? (হে হে হে হে। আপনার মাথা ভর্তি কেবলই ইয়ে কেন বলুন তো...এটার উত্তরও পাবেন, ঐ যে কিসব sexual orientation আর sexual choice নিয়ে কি সব জানি ব্যাখ্যা দেয় বিজ্ঞানীরা। নিজে কষ্ট করে খুঁজেটুজে একটু পড়ে নিন। আমি নিশ্চিত এই পর্যায়ে এসে আপনি খুঁজে পেতে জার্মানিতে ইনসেস্ট এর ওই বছর খানেক আগের নিউজটা শেয়ার দেয়ার চেষ্টা করবেন। হে হে হে হে, আমি চিনি গো চিনি তোমারে...)
৫। সবাই সমকামী হয়ে গেলে প্রজনন বন্ধ মানব সভ্যতা কি ধ্বংস হয়ে যাবে না? (এটার ছোট উত্তরও দেই। হ্যাঁ, সবাই সমকামী হয়ে গেলে আর কৃত্রিমভাবে প্রজননের হিসেবও বাদ দিলে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। একইভাবে পৃথিবীর সব মানুষও বলদ হয়ে গেলে সব উন্নতি মুন্নতি বন্ধ হয়ে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ বলদ হয়ে যাবার সম্ভাবনা খানিকটা থাকলেও সব মানুষ সমকামী হয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বলদামি বেশ একটা ছোঁয়াচে রোগ বটে তবে সমকামিতা কোনোভাবেই কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়।)
সে যাই হোক। উপরের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর অভিজিৎ রায় ছাড়া আরও অনেকে অনেকভাবে দিয়েছেন। কেন সমকামিতাকে শিশুকাম, ধর্ষকাম, পশু কামের সাথে তুলনা করা যাবেনা সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এদের চেয়ে ভালো করে ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার লেখার উদ্দেশ্য 'সমকামিতা' শব্দটিকে আরও একবার সামনে আনা। জানা বোঝার দায়িত্ব আপনার। আমি বরং এই জুটিকে সাধুবাদ দিতে দিতে আজকের মত বিদায় নেই।
যুক্তরাজ্যে প্রথম মুসলিম সমকামী জুটির বিয়ে খবরটি পড়ুন, এই দুজনের হাস্যজ্জ্বল মুখটি দেখুন। এরপর চট করে খবরের কমেন্ট সেকশনে চলে যান। এক কাগজের কমেন্ট পড়া শেষে রুচি থাকলে আরেক কাগজে যান। অথবা হাসিব মাহমুদের এই গোল্ড কালেকশন থেকে সহজেই পড়ে ফেলুন--যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি সমকামী বিয়ের খবরে ফেসবুক প্রতিক্রিয়া।
সমকামিতা নিয়ে কেন কথা বলা জরুরী? কেন সমকামীদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হওয়া উচিৎ? এই কারণে যেন কমেন্ট সেকশনের এই মানুষগুলা মিলে উপরের এই জুটিকে অতীতের মত ভবিষ্যতেও মেরে ফেলতে না পারে সেই জন্য। গোস্বা করে আপনি হয়তো বলবেন, সমকামী হোক ঠিকাছে কিন্তু নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিচ্ছে কেন? আচ্ছা মানলাম হয়তো মুসলমান বলে পরিচয় দেয়া ঠিক হয়নি, সরিয়ে নিলাম সেই পরিচয়। এবারে বলবেন, সমকামী হোক ঠিকাছে কিন্তু নিজেকে বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিবে কেন? সেটাও সরিয়ে নিলাম। এবারে বলবেন, কিন্তু মানুষ বলে পরিচয় দিচ্ছে কেন? এজন্যই তাই তার মানুষ, বাংলাদেশী, মুসলমান সকল পরিচয় আবার ফিরিয়ে দিলাম। ওই যখন শুরুর পরিচয়টা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন তখনই তার অধিকার হরণ আর তেতো বীচিটা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার কাজ হয়ে গেছে। একটা মানুষের পরিচয় তাই তার নিজেকেই নির্ধারণ করতে দিন। তেতো বীচিটাকে গিলতে চান বা না চান এর অস্তিত্বটা তো স্বীকার করুন অন্তত!
[লেখকের অনুমতিক্রমে সচলায়তন ব্লগ থেকে নেওয়া।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন