জুলাই বিপ্লবে নারীর অংশগ্রহণ একে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। হিজাব পরা ছাত্রী ও টপস-ট্রাউজার পরা ছাত্রী হাতে হাত রেখে মিছিলে সোন্নত সাহসের ছবিই বাংলাদেশ। যে দু'হাজার চব্বিশের মা হাতকড়া পরা বিপ্লবী ছেলেকে সাহস দিয়ে বলেছেন, ভয় পাইস না বাপ; সেই মা'ই বীরপ্রসূ বাংলাদেশের প্রতীক। শহীদ সাঈদের যে মা চিৎকার করে বলেছেন, চাকরি দিবু না না দে, আমার ছাওয়ালকে মারলু ক্যানে; সেই মা'ই নির্ধারণ করেছিলেন স্বৈরশাসনের অবসান। মুগ্ধের মা, রুদ্রের মা; এরকম সন্তান হারানো মায়েরা প্রার্থনা করেছিলেন খুনীর পতন। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের অনন্য জায়গা হচ্ছে এখানে শ্রমিক নারী, অভিজাত এলাকার এফলুয়েন্ট নারী সবাই মিছিলে এক হয়েছিলেন।
আর এই জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রী, শ্রমিক নারী, মধ্যবিত্ত নারী যখন হাজারও মানুষের ভীড়ে হেঁটেছেন; তখন তাদের জন্য সুন্দর-সভ্য পরিবেশ নিশ্চিত করেছে পুরুষেরা। অসভ্য স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে এই যে মানব-মানবীর ঐক্যের মিছিল; সেটাই বাংলাদেশ।
জুলাই আন্দোলনে নারী সমন্বয়কের সাংগঠনিক ও যোগাযোগ দক্ষতা; ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলেও আন্দোলনকে বেগবান রাখতে পেরেছে। নারীর যে ইন্টারপারসোনাল কমিউনিকেশনে কৌশল; তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন কোনো যোগাযোগ পদ্ধতি নেই।
পুলিশের সামনে, বিজিবি ও সেনা কর্মকর্তার সামনে নারীর যে সাহসী রুপ আমরা দেখেছি; ওরকম সাহস পুরুষের মাঝে বিরল।
যারা মাচো পুরুষ; নিজেকে অজানা কারণে নারীর চেয়ে বেশি করিতকর্মা ভাবেন; তারা শুধু একবার চোখ বন্ধ করে দেখুন, আপনাদের পরিবারের সাহসের জায়গা ছিলেন মা। বাবা যখন আপনার পরীক্ষার ফল দেখে বলতেন, এ ছেলেকে দিয়ে কিছু হবে না; এর মানুষ হওয়া সম্ভব না; মা সেই সম্ভব না কে সম্ভাবনায় রুপান্তর করেছিলেন বলেই আপনি আজ বেশ চওড়া কাঁধের কেশর ফুলিয়ে হাঁটেন।
জুলাই বিপ্লবের পুরোটাই প্রশংসার। কেবল একটি সমালোচনার জায়গা হচ্ছে, নারী সমন্বয়কদের সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ না করা। একবিংশ শতকে এসেও যদি আমরা পঞ্চায়েত সিরিজ নাটকের মতো; চেয়ারম্যান নারীকে নিষ্ক্রিয় রেখে স্বামী ঐ দায়িত্ব পালনের মতো কৌতুকপ্রদ ঘটনার জন্ম দেই; তাতে কী করে চলে।
একটু মনোযোগ দিয়ে এসএসসি-এইচএসসি-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল লক্ষ্য করুন; গড় ফলাফল হিসাব করলে নারী এগিয়ে গেছে সাফল্যে। ফুটবল আর ক্রিকেটে জাতীয় নারী ও পুরুষ দলের পারফরম্যান্স দেখুন। কনসিসটেন্ট নারী খেলোয়াড়েরা। যে কোনো দপ্তরে দেখবেন, নারী কর্মীকে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দিলে দ্বিতীয়বার বলার প্রয়োজন হবে না। অন্তর্বতীকালীন সরকারে যে নারী উপদেষ্টারা আছেন; নীরবে দেখবেন তারা কাজ করে চলেছেন। যোগ্য নারীর মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো প্রবণতা থাকে না।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা যে নারীদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দেখেছি; তারা শৈশব থেকে শিক্ষাদীক্ষায় নিজেকে প্রস্তুত করেননি। পারিবারিক প্রভাবে একটি পদে বসে; কিছু বাটপার পুরুষের যে অসৎ পুরুষতন্ত্র; সেটাই বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবে যে নারীরা অংশ নিয়ে একে সফল করলেন; পুরুষেরা তাদের পাশে হাঁটলেন বন্ধুর মতো; কিন্তু বিপ্লব সফল হবার পর সেই পুরুষদের কেউ কেউ কেন নারীর পোশাক পুলিশ হয়ে উঠলেন। নারী যদি নিজের সিদ্ধান্তে বিপ্লবে আসতে পারে; তাহলে সেই নারীকে পৃথিবীর কোনো ব্যাপারে ডিকটেশান দেওয়ার পুরুষ কে!
পুলিশ বাহিনীটি হারুন ও মনির বাহিনী বলে প্রায় অচল হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু পুরুষকে পথে ঘাটে নারীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে দেখা গেছে। এর চেয়ে বড় কৃতঘ্নতা তো কোথাও দেখিনি। উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না; সেই তো কৃতঘ্ন। মনে করে দেখুন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারী কোটা অবসানের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দাবি জানিয়েছিল ছাত্রীরা।
ফেসবুকে আওয়ামীলীগ দলীয় ললিতা আর জামায়াত দলীয় রাবেয়া; জুলাই বিপ্লবে গড়ে ওঠা নারী ঐক্যে চিড় ধরাতে চেষ্টা করছে। গেরুয়া পতাকা আর কালেমা সম্বলিত কালো পতাকা একই বিপু ফান্ডে কেনা হয়; জুলাই বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে; স্বৈররাক্ষসকে ফিরিয়ে আনতে। ভূ-রাজনীতির সেসব ছায়ানৃত্য খেয়াল না করে; অযথা আর্যস্বপ্নে বিভোর হয়ে একদল পুরুষ নিজেকে ব্রাহ্মণ ভাবলে আর আরেকদল পুরুষ নিজেকে অটোমান ভাবলে; দিনশেষে দেখবেন; আপনার চকির তলায় ছুঁচোর কেত্তন।
আপনাকে বিভাজন বটিকা খাইয়ে দিল; আর আপনি বিরাট শিবাজি কিংবা আর্তুগ্রুল সেজে ঘুরবেন, নারীর সঙ্গে চোটপাট করবেন; বাংলাদেশটাকে কী নিজেদের ফাদার'স ড্রইংরুম ভাবেন নাকি!
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার মূল কারণ; নারী শ্রমের উপস্থিতি। শ্রীলংকার ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ শিক্ষিত মায়ের শিক্ষিত সন্তানদের কর্মকুশলতা।
৫ আগস্টকে যে জেন জি'রা নতুন স্বাধীনতা বলছে; সে স্বাধীনতা প্রমাণ হবে যদি নারী স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে; শিক্ষা গ্রহণ ও কাজে স্বচ্ছন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে।
কেন ইউরোপের দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বছর দশেকের মধ্যে কল্যাণরাষ্ট্র গড়তে পেরেছে; এর মূলকারণ নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আর কল্যাণরাষ্ট্রগুলোতে পুরুষের কাজের চিন্তা থাকে মস্তিষ্কে; জৈবিক চিন্তা থাকে উপাঙ্গে; মানে যেটা যেখানে থাকার কথা। কিন্তু অকল্যাণরাষ্ট্রের ব্যর্থ পুরুষ সমাজের জৈবিক চিন্তা থাকে মস্তিষ্কে আর কাজের চিন্তা থাকে উপাঙ্গে। এ কারণেই সমসাময়িক রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে যায় সভ্যতার পাদপ্রদীপের দিকে। আর অকল্যাণরাষ্ট্রগুলো ল্যাংচাতে থাকে; একই অন্ধকার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে।
বাংলাদেশ ও ইউরোপের নারী সমাজের সততা, শ্রম নিষ্ঠা, অলরাউন্ডার দক্ষতা, ইতিবাচকতা একই রকম। বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে পুরুষ সমাজের সার্বিক দক্ষতার ক্ষেত্রে। কারণ নারী কী পোশাক পরবে, নারী কইভাবে চলবে কী করবে; এইসব চিন্তা করতে গিয়ে কাজের কাজগুলো করে উঠতে পারে না পুরুষ সমাজের বড় একটি অংশ।
আমরা লক্ষ্য করেছি, আমাদের সমাজে কন্যাশিশু নিরাপদ নয় প্রগতিশীল গানের শিক্ষক ও ধর্মশীল আমসিপারা শিক্ষকের কাছে। আর পেডোফিলিক সর্বদলীয় আত্মীয়স্বজন তো আছেই। এ কারণেই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে, পুরুষ মানুষ আবার খালু। এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই মনসুন ওয়েডিং চলচ্চিত্রের কথা।
সুতরাং নারীর জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র বিনির্মাণই হোক জুলাই বিপ্লবের শপথ। তাহলে রাষ্ট্র আপনা-আপনি কল্যাণরাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন