যাচ্ছি টরন্টো। মাঝখানে কয়েকদিনের একটা যাত্রা বিরতি নিয়েছি নিউ ইয়র্কে। সন্ধ্যায় পুরোনো কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে সান্ধ্য আড্ডার আয়োজন করলে ইরানি বন্ধু ফাতিমা। সিরিয়াস মেয়ে। ম্যাক্স আমিনিকে খুব একটা পছন্দ করে না। যাই হোক দেখতে দেখতেই ১১-১২ জন এসে হাজির। বন্ধুদের বন্ধু অনেকে।
মিশরীয় মেয়ে অসিরিয়া টেবিলে আমার মুখোমুখি। সে মোবাইলে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, দেখ তো এই ছেলেটাকে চেন কিনা। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও তাকে চিনতে পারলাম না। সে ঝলমলে মুখে বলল, এই ছেলেটাকে আমি বিয়ে করেছি। বাংলাদেশি। বাড়ি সন্দ্বীপ। মস্ত চাপাবাজ। সে বলেছে, বাংলাদেশে নাকি সবাই তাকে চেনে। খুবই ফেমাস। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ওর সেন্স অফ হিউমার নিশ্চয়ই খুবই ভালো, তাই তো মনে হয় তাকে বিয়ে করেছ। এরপর সন্দ্বীপ-মাছ-শুটকি-সমুদ্র-বে অব বেঙ্গল ইত্যাদি আলোচনা শেষে জানা গেলে কায়রো শহরে বড় হওয়া এই মেয়ে এখনও কোনোদিন পিরামিড দেখতে যায়নি এই যাচ্ছি যাব করে। মুজতবার গল্প বললাম তাকে, কীভাবে সেই ছোটোবেলাতেই এই লেখক আমাদের মিশর ঘুরিয়ে এনেছেন তার লেখার মাধ্যমে। এরপর এল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গল্প। বাংলাদেশি স্বামীর কাছে এ নিয়ে সে আগেই শুনেছে। আবারও জানতে চাইল।
আমি বললাম, কেন গত জুলাই আমাদের ৩৬ দিনের ছিল। বললাম পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে মানুষ খুনের কথা। কীভাবে বাংলাদেশের মানুষ বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে। আমার চোখটা মনে হয় একটু ভিজে উঠেছিল হেলিকপ্টার দেখতে গিয়ে একটা বাচ্চার গুলি খাওয়ার কথা বলতে গিয়ে।
আমার বাম পাশে বসেছিল লেবানিজ মেয়ে ফাহা। সে এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের জুলাইয়ের গল্প শুনছিল। জানতে চাইল কতজন মারা গেছে এই অভ্যুত্থানে। বললাম— সরকারি হিসেবে সাড়ে আটশো থেকে নয়শোর মতো। আর আহত হয়েছে বিশ হাজারের মতো। শুনে সে খুবই মন খারাপ করে বলল, আমি খুবই দুঃখিত। এরপর সে খুটিয়ে খুটিয়ে আরও অনেক কথা জানতে চাইল। সেসব বলতে বলতে গত জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত এতগুলো মানুষ হারানোর বিষাদ পুরো টেবিলে ছড়িয়ে পড়ল। শেষে বললাম, আমার মনে হয় এত কম সময়ে চোখের সামনে এত মৃত্যু পুরো বাংলাদেশকে একটা ট্রমায় ফেলে দিয়েছে। সেখানে কেউ আর স্বাভাবিক নাই। এরপর বললাম, তোমাদের লেবাননের কী অবস্থা? সে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, মাত্র খবর পেলাম, আজকে আমাদের দেশে একদিনে মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে—ইজরাইলি এয়ার স্ট্রাইকে একদিনে ৫০০ মানুষ মারা গেছে।
পুরো টেবিল একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমিও কী বলব বুঝতে পারলাম না স্যরি বলা ছাড়া। দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমার মৃত্যুর বোঝা যেন হঠাৎই হালকা হয়ে গেল।
জুলাই-আগস্টের পর এই প্রথম আমার মনে হলো, আমার দুঃখই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা নয়, সামষ্টিকভাবেও নয়। দ্বিতীয় আরেকজনের কাছে আমার দুঃখ কিছুই না। প্রতিদিন মানুষ আরও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা করে তৃতীয় বা চতুর্থজনকে জিতিয়ে দেওয়ার।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন