সদ্য সমাপ্ত যুক্তরাজ্যের (UK) সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবার ভোটার হিসেবে অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতা হলো আমার। শুনতে অবাক লাগলেও, এই দেশের নির্বাচনে কমনওয়েলথভুক্ত দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা ভোট দিতে পারেন। একজন কমনওয়েলথ দেশের (ভারতীয়) আন্তর্জাতিক পিএইচডি ছাত্র হিসেবে এখানে আসার পর প্রথমবার ভোটাধিকার পাই। ভারত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হলেও, UK এর গণতন্ত্র কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এবং সুষ্ঠু ভোটের জন্য সর্বজনবিদিত। মধ্য ওয়েলসের এক পর্যটক ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক Ceredigion Bay এর সামুদ্রিক তট বিশিষ্ট ছোটো শহর Aberystwyth এর বাসিন্দা আমি বিগত এক বছর ধরে। নির্বাচন নিয়ে এখানে আমাদের উপমহাদেশের মতো উত্তেজনা, ক্যাম্পেইনিং, পোস্টার, দেয়াল লেখা, মিছিল, মিটিং কিছুই হয় না। বেশিরভাগ রাজনৈতিক প্রচারণাই সোশ্যাল মিডিয়া/ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, প্যাম্পলেট আর যত সামান্য ছোটো আকারের হোর্ডিংস অথবা সাইনবোর্ড এসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ। এছাড়া এখানে ভোটের সময় আমার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মতো কোনো গুণ্ডাগিরি চলে না কিংবা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মতো রাতের ভোটের মতো ইন্টারেস্টিং বিষয়ও নেই।
কমনওয়েলথ এর নাগরিক হিসেবে UK সরকার এর 'Right to Vote' ওয়েবসাইটে নিজের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রার করতে হয় এবং সবকিছু ঠিক থাকলে, আঞ্চলিক নগর পরিষদ আপনার বাসস্থানের ঠিকানায় চিঠি 'পোল কার্ড' পাঠিয়ে দেবে। পুরো প্রক্রিয়াটিই খুবই সহজ ও সরল। নির্বাচনের দিনটি ছিল আমার জন্য বিশেষ, কারণ পিসির (পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জিকে স্যাটায়ার করে পিসি ডাকা হয়) বদান্যতায় নিজের দেশে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই আমার। আমার নিকটস্থ ভোটকেন্দ্র ছিল Lanbadarn Fawr Church Hall যেটি একটি কমিউনিটি হল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয় যেমন বিবাহ, ক্রিসমাস বা স্মারক সভা।
UK তে ভোট দেওয়ার সময় ছিল সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা। আমি বেলা ১২:৪৫ নাগাদ পৌঁছাই যখন কোনোরকম ভিড় ছিল না। হলের ভেতরে ছিলেন ২ জন মহিলা ভোটার আর আমার সঙ্গে একটি আমার বয়সী ছেলে। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার মধ্যে যে একটি আনন্দ মিশ্রিত দায়িত্ব আছে তার অনুভব এক ও অদ্বিতীয়। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করার পর একটি স্বাগত হাসি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানান প্রিসাইডিং অফিসার। পরিচয় প্রমাণ করার পরে, ভোট রেজিস্ট্রার লিস্টে নাম মিলিয়ে নেওয়ার পর আমাকে ব্যালট পেপার দেওয়া হয়। নানা পার্টির প্রার্থীদের নাম লেখা ছিল ইংরেজি এবং ওয়েলশ ভাষায়। ব্যালট পেপারে আমার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য বৃত্তে একটি ক্রস চিহ্ন এঁকে, আমি আমার প্রথম ভোটটি দেই এবং সেটি ভাঁজ করে ব্যালট বক্সে ফেলে দেই। এ ছাড়াও দেখলাম যে যাদের শ্রবণ শক্তি কম, দেখতে অসুবিধা হয়, তাদের জন্য প্রার্থীদের নাম পড়ে দেওয়ার অডিও মেশিন ও ম্যাগনিফাইং গ্লাস রয়েছে। অন্ধ মানুষদের জন্য ব্রেইল লিপিতেও ব্যালট পেপার আছে। এ ছাড়াও পোস্টাল ব্যালট এবং আপনার চেনা অন্য কোনো ব্যক্তিকেও আপনি আপনার ভোট দেওয়ার জন্য অথরাইজ করতে পারেন। কিন্তু তার জন্য আগে থেকে নির্দিষ্ট প্রশাসনকে জানাতে হয়। মানে সবার জন্যেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
ভোট দেওয়ার পরে, কেন্দ্রে থাকা কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসার সময় এক ধরনের গর্ব অনুভব করি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে বিদেশি হলেও UK এর সমাজের একজন অংশ হিসেবে আরও বেশি সংযুক্ত করেছে এবং বহির্বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছে। এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন