বইমেলা ২০১৯ শুরু হওয়ার আগেই আমি জানতে পারলাম, এবার মস্তিষ্কের ক্যানভাস নামে একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। যেহেতু বইয়ের নামে ‘মস্তিষ্ক’ কথাটি উঠে এসেছে, সেহেতু ধারণা করেছিলাম এটি একটি সাইকোলোজিকাল থ্রিলার বই। বইটির প্রচ্ছদে লেখকের রহস্যময় হাসি ও আলো-আধারের অপরূপ রহস্যময় খেলা দেখে এই ধারণা আরও শক্ত হয়ে যায়। তাই এ ঘরানার বইয়ের ফ্যান হিসাবে এটি আমার এবারের বই কেনার লিস্টে শীর্ষস্থানে ছিল।
বইটি খোলার আগে বইটির প্রচ্ছদটি খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলাম। লেখক সেখানে রহস্যময় এক সুখী সুখী হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছেন বইটির সম্ভাব্য পাঠকদের দিকে। সেই হাসিতে কত যে জানা-অজানা রহস্য! রহস্যময় সে চোখে ডুবে যেতে যেতে রিয়েলাইজ করলাম মস্তিষ্কের ক্যানভাস মূলত একটা চিত্রকলার বই।
প্রচ্ছদে লেখকের এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে বইটির ভেতরে চলে গেলাম।
প্রচলিত চিত্রকরেরা তাদের চিত্রকর্ম অংকনের জন্য কাগজ, কাপড়, তৈজস কিংবা ডিজিটাল মাধ্যম বেছে নিলেও এই বইয়ের লেখক (বা আর্টিস্ট) ক্যানভাস হিসাবে বেছে নিয়েছেন তার মস্তিষ্ককে। কিন্তু টেলিপ্যাথি বা মাইন্ড রিডিং ব্যবস্থা এখনো ঠিকমতো গড়ে উঠতে পারেনি বলে ছবিগুলো বইয়ে শব্দের মাধ্যমে ইনক্রিপ্টেড হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাই এই বইয়ের চিত্রকর্ম অনুধাবন করার জন্য প্রথমে এটি ডিকোড করার উপায় নিয়ে কিছুক্ষণ ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটি করে প্রবলভাবে ব্যর্থ হয়ে নিজে নিজেই এই ‘শব্দ টু চিত্র’ কনভার্ট করা শুরু করলাম।
বেশ কিছুক্ষণ এই শিল্প শোষণের চেষ্টায় লেগে থাকার পর ধীরে ধীরে আমি মনোবল হারাতে শুরু করলাম। আমি মনে হয় আর পারবো না- এমন এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে শুরু করলো। নিজের অজ্ঞতার তমসায় হারিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ আমি মনের এক চিপাগলি থেকে ক্ষীণ আওয়াজ পাই, ‘তুমিও পারবে।’ আমি হতভম্ব হয়ে এবার আরো কঠোর মনোযোগে লেপ্টে রইলাম এই বইয়ের পাতায়। আমাকে পারতেই হবে। বারোটায় এই বই বা চিত্রকর্ম গলাধঃকরণের চেষ্টা শুরু করার পর ঘন্টার কাটা যখন ৬ ডিজিটে এসে ঠেকলো, তখন যেন আমি বোধি পেয়ে বসলাম (হতে পারে ঘুমের অভাবে হ্যালুসিনেশন)। এই ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো যখন দেখতে পেলাম, পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের কথা মনে পড়ে গেল। নগদ পয়সা খরচ করে এই বই কেনার কথা ভেবে আমার মন সেই পিকাসোর ছবির নীল বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।
একটা পর্যায়ে সদ্যপ্রাপ্ত বোধির যন্ত্রণা সইতে না পেরে বইটাই বন্ধ করে ফেললাম। বন্ধ বইয়ের দিকে খোলা চোখে তাকিয়েছিলাম কিছুক্ষণ একরাশ হতাশা নিয়ে। তখনই কিছু একটা ঘটে গেল। আমার দৃষ্টি যেন আবদ্ধ হয়ে গেল প্রচ্ছদে লেখকের সেই ছবির দিকে। ঐ দুটি চোখের রাঙানিতে আমার ডিপ্রেশন ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। এমন অনুপ্রেরণামূলক হুমকিতে আমি আবারও মোটেভেটেড হলাম বইয়ের গভীরে যেতে। আর কি অদ্ভুত এক জাদু! সবই যেন বুঝতে পারছি। পরবর্তী সময়টায় আমার অভিজ্ঞতা হলো সুশীতল গাড়িতে করে লংড্রাইভে যাওয়ার। এই এক ড্রাইভেই লেখক বুঝিয়ে দিলেন, শিল্প ও জীবনের মাঝে যে অসীম টানাপোড়েন চলছে আদিকাল থেকে। জীবনের সবরকম সংকট আমি বুঝে ফেলছিলাম। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একেকটি মাইলফলক। জাদুকরী গাড়িটি আমাকে দুরন্ত গতিতে একের পর এক মাইলফলক অতিক্রম করিয়ে দিচ্ছিল।
চিত্রকলার ইতিহাসে আগামীদিনে মাইলফলক হয়ে উঠবে যে বইটি, সেটার দুয়েকটি ছবি নিয়ে কথা না বললেই নয়। একটা ছবিতে আমরা দেখতে পাই, একজন ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে গিয়ে চুপচাপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। সেই ভিডিও যেই দেখছে, সোজা গিয়ে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ছে। বুঝতে পারি, এটা মূলত রূপক। চিত্রকর বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো কঠিনতম কাজকে সম্ভব করার দুর্বার সাহস শুধু যে কথার মাধ্যমেই দেয়া যায় তা হয়, মাঝে মাঝে নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেই শক্তি! আরেকটা ছবিতে দেখা যায়, কিছু মানুষ ফেসবুকে একটি লাইভ ভিডিও দেখছে, কিন্তু তাদের সবার হাতে ৫টার বদলে ৬টা করে আঙুল। আহা! কি রূপক! এখানে শিল্পী বলতে চেয়েছেন, সিক্স ডিজিট স্যালারি অর্জনের নিগূঢ় রহস্যের কথা। আমি মুগ্ধ হয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকি। আরেকটা ছবিতে দেখা যায় একটা মাথার খুলিতে দশটা চোখ। এ ছবিতে বোঝানো হয়েছে, মোটিভেশনাল স্পিচ শুনে মানুষের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে অন্তর্দৃষ্টি। মোট কথা, সুররিয়েলিজম ও ম্যাজিক রিয়েলিজমের সমন্বয়ে শিল্পী সুখন যেন ছবিগুলোতে সৃষ্টি করেছেন নতুন এক বাস্তবতা, মোটিভেশন রিয়েলিজম।
এছাড়াও মস্তিস্কের ক্যানভাসের প্রতিটা ছবির কালার গ্রেডিং অসাধারণ। রঙধনুর সাতটি রঙ ব্যবহৃত হয়েছে সকল ছবিতে। একজন সফল মোটিভেশনাল স্পিকার এবং সিক্স ডিজিট স্যালারির মালিক হওয়ার পাশাপাশি সুখন ভাই শিল্পী হিসেবেও এই বইটিতে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
এভাবে একটা সময় শেষ হয়ে আসল এই চমৎকার পথটি। একটা অদ্ভুতুড়ে বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করে ফেলল। কিন্তু বইটি বন্ধ করতেই আবার সম্বিৎ ফিরে পেলাম ঐ দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে। তিনি যেন আমায় বলছেন, এই পৃথিবীতে ডিপ্রেশন আর বিষণ্ণতার কোন স্থান নেই।