অর্থ বড় না প্রেম (মতান্তরে কাম) বড় এই রকম জটিল বিষয়ে আমার একটি গল্প ছিল সম্পাদকের দপ্তরে।
সারা বছর ধরে কত গল্পই যে লিখি। সম্পাদক ছাপেন, পাঠকেরা পড়েন, তারপর ভুলে যান।
আমিও ভুলে যাই। এত লিখলে কারও কিছু মনে থাকে।
এখন যে গল্পের কথা বলছি, সে গল্পের ব্যাপার কিন্তু একটু আলাদা।
এই গল্পটি ছাপা হয়নি।
সম্পাদক মহোদয়ের পছন্দ হয়নি তা নয়। অনিবার্য এক কারণে ছাপা হয়নি। পাঠকেরা গীতা না পড়লেও সেই শ্লোক মাঝে মধ্যে খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পরলোক গমনের অলংকৃত বিজ্ঞাপনে ছাপা হয়, যার মোদ্দা কথা হল আত্মাকে সুঁচ ফুটো করতে পারে না, আগুন পোড়াতে পারে না। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমার গল্পও সেইরকম।
এই পটভূমিকায় এবারের এই গল্প।
গল্পটি নতুন করে লিখতে হবে।
কিন্তু একই গল্প কি দুবার লেখা যায়?
গল্পের ধরনটা আবছা আবছা মনে আছে। কিন্তু পুরো গল্পটা কিছুতেই একরকম হবে না।
একই নদীর জলে দুবার ডুব দেওয়া যায় না। একই পথে দুবার হাঁটা যায় না। নদীর জল বয়ে যায়, রাস্তার লোকজন, আলোছায়া বদলিয়ে যায়। আরও একটু ঘনিষ্ঠভাবে একবার আমি নিজেই লিখেছিলাম, একই ঠোঁটে দুবার চুমু খাওয়া যায় না। প্রথম চুমু খেতে দ্বিতীয় চুমু ওষ্ঠাধিকারিণী খণ্ডমুহূর্তে বদলিয়ে যান।
এ সমস্তই মেনে নিয়ে এবার গল্পটাকে ধরার চেষ্টা করছি।
গল্পের নায়িকার নাম খুব সম্ভবত জয়ন্তী। এ নামটা আমার খুব প্রিয়। তা ছাড়া, এ নামে আমার পরিচিত কেউ নেই, তাই নিরাপদে ব্যবহার করা যায়। তবু অনেক সময় একটু এদিক ওদিক করে জয়ন্তী, জয়া, বিজয়া এসব নামও ব্যবহার করি।
তবু, আপাতত জয়ন্তীই চলুক।
জয়ন্তী নববিবাহিতা। বারাসতের কাছে একটা গ্রাম মাঠপুকুর। সেখানে বাপের বাড়িতে থাকে। কাছেই কাটাখালি গ্রামের একটা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা।
জয়ন্তীর বরের নাম যাই হোক, আমরা এ গল্পে জয়ন্তীর নাম মিলিয়ে তাকে জয়ন্ত বলে ডাকব। জয়ন্ত বারাসত কলেজের বি এস সি। বেশ ভাল ছাত্র। সরকারি ক্লার্কশিপ পরীক্ষা দিয়ে সে একটি কেরানির চাকরি করছে সল্টলেকে রাজ্য সরকারের একটি ডিরেক্টরেটে। আজকাল এসব চাকরিতে মাইনে ভাল, ভবিষ্যত ভাল, নিরাপত্তাও যথেষ্ট।
জয়ন্তের একটাই মহাদোষ। সে বড় কৃপণ। আড্ডার ভাষায় রাম চিপপোস।
অবশ্য অনেক সময় দেখা যায় কৃপণ দুর্নাম কোনও কোনও মানুষের ঘাড়ে অনায়াসে চেপে বসে অতি সামান্য কারণেই। হয়তো ভদ্রলোক চায়ে চিনি কম খান, হয়তো তিনি অফিসে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা খুব বেশি কাটান। হয়তো প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়েতে দুশো টাকা দামের শাড়ি না দিয়ে চল্লিশ টাকা দামের কবিতার বই দেন।
কিন্তু জয়ন্তের কৃপণ অখ্যাতির ব্যাপারে আরও গুরুতর ঘটনা আছে। দু-একটা উদাহরণ দিই:
(১) জয়ন্ত নিজে রান্না করে খায়। সে প্রথমে ডাল রাঁধে। তারপর রাঁধা ডাল থেকে সেদ্ধ হয়ে যাওয়া কাঁচা লঙ্কা, শুকনো লঙ্কা তুলে সেগুলো দিয়ে তরকারি রাঁধে নতুন করে লঙ্কা দেয় না।
(২) জয়ন্ত দাড়ি কামানোর পরে সাবানের বুরুশ ধোয় না। ভাত খেয়ে উঠে ধোয়। এতে ভাত খেয়ে হাত ধোয়ার জন্যে আলাদা সাবান ব্যয় করতে হয় না।
(৩) দেশলাই অগ্নিমূল্য হওয়ার পরে জয়ন্ত আর দেশলাই ব্যবহার করে না। সিগারেট লাইটার ব্যবহার করে। কিন্তু যখন ব্যবহার করত, দেশলাই বাক্সগুলোর মোটা মোটা কাঠিগুলো বার করে ব্লেড দিয়ে সেগুলো দু-টুকরো করত। এভাবে বিশ-পঁচিশটা কাঠি বেশি হয়ে যেত।
কৃপণ স্বভাবের মানুষদের সম্পর্কে এসব গল্প তো অনেক ক্ষেত্রেই খাটে। কিন্তু জয়ন্ত সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত ঘটনাগুলো না বললে তাকে পুরোটা বোঝা যাবে না।
সল্টলেকে চাকরি হওয়ার পরে সে বাগুইহাটির প্রত্যন্ত সীমানায় একটা বাড়ির বাইরের দিকে একটা ঘর ভাড়া করে। কমন বাথরুম, এক চিলতে বারান্দায় রান্নার জায়গা।
চাকরিতে ঢোকার কয়েক মাসের মধ্যে জয়ন্ত নতুন বাসস্থানে চলে গেল। অফিসের সহকর্মীরা, তাদের মধ্যে যারা ঘনিষ্ঠ তারা চাপ দিতে লাগল খাওয়াতে হবে, পানীয় প্রবণ দু-একজন বলল, হাউস ওয়ার্মিং পার্টি দাও জয়ন্ত, শুধু দু-বোতল হুইস্কি, আমরা চানাচুর নিয়ে যাব।
জয়ন্ত উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু তার সহকর্মীরা, তার বন্ধুরা সে যে কী জিনিস বুঝতে পারেনি।
সহকর্মীরা যখন দেখল জয়ন্ত মোটেই উৎসাহ দেখাচ্ছে না, তারা ঠিক করল অনাহূত চলে যাবে।
এক রবিবার সকালে তিন-চারজন সহকর্মী বন্ধু অনেক খুঁজে খুঁজে বাগুইহাটির বাসস্টপ থেকে সচ্ছল জনপদ, ইতস্তত বহুতল, পানাপুকুর, ধানক্ষেত ইত্যাদি পার হয়ে অনেক খুঁজে জয়ন্তের বাড়িতে পৌঁছল।
কৃপণ ব্যক্তিরা খুব অলস হয়। ছুটির দিনের সকাল, আরামে লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল জয়ন্ত। হঠাৎ সে জানলা দিয়ে দেখে বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ের পাশের রাস্তা দিয়ে তার অফিসের তিনজন সহকর্মী হই হই করে আসছে।
উপস্থিত বুদ্ধির কোনও অভাব নেই জয়ন্তের। তাদের গৃহাভিমুখী এই চলন্ত দৃশ্য দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে জানলা বন্ধ করে দরজা ভেজিয়ে মশারি টাঙিয়ে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
একটু পরে দরজায় টক টক শব্দ হতে সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, কে?
বাইরে থেকে উত্তর এল, আমরা, সেই সঙ্গে ভেজানো দরজাটা একটু ঠেলে তিনজনই ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্ত চেঁচিয়ে উঠল, এসো না, এসো না।
সবাই থমকিয়ে যেতে জয়ন্ত বলল, আমার মায়ের দয়া হয়েছে। আজকের দিনেই তোমরা এলে?
এই দুঃসংবাদে সবাই হতচকিত হয়ে গেল, এই তত পরশু দিন শুক্রবারেই জয়ন্ত অফিস থেকে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু মায়ের দয়া মানে বসন্ত, মানে পক্স। এখন যদিও স্মল পক্স কদাচিৎ, চিকেন পক্স কম গোলমেলে নয়। বান্ধববৃন্দ খুব বেশি বাহাদুরি না দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করল।
এর পরের ঘটনা আরও চমৎকার। বারাসত কলেজে পড়ার সময় জয়ন্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল অমলেশ। সেই অমলেশ সেলস ট্যাক্স ইনস্পক্টর হয়েছে। এখন কাজ করছে জিয়াগঞ্জে। সে কী কাজে একদিন কলকাতায় এসেছে, সেটা ছিল এক শনিবার, অফিস কাছারি বন্ধ। খুঁজে খুঁজে অমলেশ জয়ন্তের বাড়িতে সকালবেলায়। জয়ন্ত যখন অমলেশের কাছে শুনল সে দুদিন থাকবে, সে অমলেশকে বাসায় বসিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা খানেক পরে ঘামতে ঘামতে ফিরল। ফিরে এসে বলল, শনিবার পোস্ট অফিসে বড় ভিড় হয়।
অমলেশ জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ পোস্ট অফিসে কেন?
জয়ন্ত বলল, টাকা পয়সা ঘরে যা ছিল সব মানিঅর্ডার করে দিয়ে এলাম।
অমলেশ বলে, সব টাকা কাকে পাঠালে? কাকে আর পাঠাব? জয়ন্ত জবাব দেয় অফিসের ঠিকানায় আমার নামেই টাকাটা পাঠালাম।
অমলেশ অবাক। কিন্তু কেন?
জয়ন্ত বুঝিয়ে বলে, তুমি পুরনো বন্ধু। অনেকদিন পর এসেছ, দুদিন থাকবে। হঠাৎ যদি আবেগের মাথায় বেহিসেবি খরচ করে ফেলি। তিন-চার দিন পরে অফিসে তো টাকাটা পেয়েই যাব।
ইতিমধ্যে জয়ন্তের বিয়ে হয়েছে। নববধূ জয়ন্তী হাসিখুশি, দিলখোলা তন্বী তরুণী। জয়ন্তী স্বামীকে খুব একটা কাছে পায় না। শনিবার সন্ধ্যাবেলা সে স্বামীর কাছে বাগুইহাটিতে আসে। কিন্তু জয়ন্তের সেটা পছন্দ নয়। বাড়িতে বউ আসা মানেই সে বড় খরচের ব্যাপার। তার ইচ্ছে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো সে শ্বশুরবাড়িতেই কাটায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে একেবারে সোমবার সকালে শ্বশুড়বাড়ি থেকে সরাসরি অফিস চলে আসবে। কিন্তু বাপের বাড়িতে জয়ন্তী লজ্জা পায়। তার ইচ্ছে নয় জয়ন্ত ঘনঘন আসে। পয়সা বাঁচবে তাই জয়ন্তর শ্বশুরবাড়ির ব্যাপারে কোনও সংকোচ নেই। তবে কোনও কোনও সপ্তাহে জয়ন্তী জোর করে স্বামীর ঘরে চলে আসে। এইভাবে চলে যায়। জয়ন্ত জয়ন্তীকে থাকতে মানা করে বলে, ছোটঘর, ছোট বিছানা। রান্না খাওয়ার জায়গা নেই। জয়ন্তী বলে, আমার কোনও অসুবিধে নেই। মাঝেমধ্যে সে আচমকা এসে জয়ন্তকে নিয়ে নিউমার্কেটে কিংবা সিনেমায় যাওয়ার চেষ্টা করে। সব সময়ে অবশ্য সফল হয় না। তখন ঘরদোর সাজায়, জানলার পর্দা টাঙায়, যাই হোক নিজের ঘর।
গত সপ্তাহে জয়ন্তের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা। সপ্তাহান্তে সোমবার দোল। নতুন জামাই দোল খেলে মঙ্গলবার শ্বশুরালয় থেকে অফিসে চলে যাবে। কিন্তু এ যাত্রায় ভাগ্য জয়ন্তীর সহায়, মধ্য সপ্তাহে বুধবার ভোরে আচমকা ঝড়ে কাটাখালি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরনো টিনের চালা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, ভাগ্যিস তখন ক্লাস হচ্ছিল না। সোমবারের আগে স্কুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এদিকে শুক্রবার বিকেলেই জয়ন্ত চলে আসবে। অনেক ভেবেচিন্তে জয়ন্তী বৃহস্পতিবার সকালে জয়ন্ত অফিস বেরোনোর আগেই নিজের বাড়িতে প্রবেশ করল।
আর মাত্র আজকের রাত। জয়ন্ত সপ্তাহশেষের খরচ বাঁচানোর আনন্দে গুনগুন করে আমার পরান যাহা চায় গাইতে গাইতে গেঞ্জি গায়ে দিচ্ছিল এমন সময় জয়ন্তীকে কাঁধে একটি ঝোলা ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় উঠতে দেখে আঁতকিয়ে উঠল।
জয়ন্তী বলল, ভয় পেলে চলবে না। আমি এসে গেছি। দোল কাটিয়ে যাবাস্তম্ভিত জয়ন্ত বলল, এ কদিন খাবে কী, চাল-ডাল সঙ্গে কিছু এনেছ।
জয়ন্ত কিছু বোঝার আগে জয়ন্তী তাকে অচকিতে দুই বাহুতে জড়িয়ে দুদিনের না কামানো গালে চুমু খেতে খেতে বলল, আমার চাল-ডাল কিছু লাগবে না, আমি শুধু এই খাব। ছাড়ো, ছাড়ো বলে জয়ন্ত ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে পড়ল, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে। আমার দেরি হচ্ছে না, জয়ন্তী আরও জাপটিয়ে ধরল জয়ন্তকে। পুনশ্চঃ এক কৃপণের গল্প এভাবে শেষ করা উচিত নয়। আগের গল্পটায় আরও একটু জাপটা-জাপটি ছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। জয়ন্ত-জয়ন্তী সুখেই আছে, দুজনেই বাগুইহাটিতে আছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন