‘দেশ কোথায়?’
‘টাঙ্গাইল।’
‘বাড়ি কোথায়?’ ‘টাঙ্গাইল।’
হিন্দিতে বলা হয় মুলুক আর ঘর। যথা মুলুক দ্বারভাঙা, ঘর মধুবনী। আর আমাদের হল দেশ আর বাড়ি। দুইই এক, দেশ যদি টাঙ্গাইল, বাড়িও টাঙ্গাইল।
দেশ বলতে যা বুঝি, বাড়ি বলতেও তাই বুঝি। তবু দেশের বাড়ি কথাটার একটা আলাদা মানে আছে। আলাদা স্বাদ গন্ধ। স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
সে এক ভিন্ন কালের ভিন্ন পৃথিবীর, অনেক দূরের দেশ। দেশের বাড়িতে এখনও হয়তো যাওয়া যায়। কিন্তু সেই পৃথিবী আর কোথাও এখন নেই। ঘাসের শীতের ওপরে শিশির বিন্দুর মতো, শরৎকালের নীল আকাশের সাদা মেঘের মতো, শীতের সকালের বিষণ্ণ কুয়াশার মতো, বউ-কথা-কও পাখির মতো সেই পৃথিবী, সেইসব দিন কবে ফুরিয়ে গেছে।
কলকাতা থেকে টানা চব্বিশ ঘন্টার পথ। অনে সময় তার থেকে বেশি সময়ও লাগে।
সন্ধেবেলায় শেয়ালদা মেইন স্টেশন থেকে সুরমা মেল। এই সুরমা মেল পদ্মার ওপারের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পেরিয়ে ঈশ্বরদি জংশন হয়ে উত্তরবঙ্গ-আসামের দিকে চলে যায়। এই ট্রেনের সঙ্গে জোড়া থাকে, ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস, থার্ড ক্লাস সমেত কয়েকটি সম্পূর্ণ কোচ, তার সঙ্গে মালগাড়িও আছে। এই কোচগুলি ঈশ্বরদিতে কেটে রেখে জুড়ে দেওয়া হয় সিরাজগঞ্জ প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে।
ইঞ্জিন বদলানো কোচ জুড়ে দেওয়া, জল তোলা ইত্যাদি আনুষঙ্গিক ব্যাপার মিটে যাওয়ার পর সেই প্যাসেঞ্জার ট্রেন ঘন্টা দুয়েক বাদে রওনা হবে সিরাজগঞ্জের দিকে।
সন্ধ্যায় রওনা হয়ে, মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর শেয়ালদা থেকে ব্যারাকপুর, রানাঘাট, পোড়াদহ এবং পদ্মার দুই পারে দুই স্টেশন ভেড়ামারা এবং পাকফিতে থেমে অবশেষে ঈশ্বরদিতে এসে পৌঁছেছে। এবার গন্তব্য সিরাজগঞ্জ, ভোর ভোর পৌঁছে যাবে সেখানে।
এ সেই সিরাজগঞ্জ স্টেশন যেখানকার রুই-কাতলা-ভারি মৃগেল যার একডাকে নাম ছিল সিরাজগঞ্জের রুই, দশকের পর দশক কলকাতার বাঙালি হেঁসেলে আমিষ জুগিয়েছে। সিরাজগঞ্জের রুইমাছ কলকাতায় এসে কাটাপোনা হয়েছে। শ্যামবাজার, ভবানীপুর, বালিগঞ্জের বাঙালিবাবুরা, মাস্টারমশাই, কেরানিবাবু, উকিল-মোক্তার এক টুকরো করে কাটাপোনার ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বংশানুক্রমে আপিস ছুটেছেন।
ওই যে সিরাজগঞ্জ প্যাসেঞ্জার সকাল বেলায় এসে সিরাজগঞ্জ পৌঁছল সেটাই সন্ধ্যাবেলা আবার ঈশ্বরদির দিকে ফিরবে। সারাদিন ফিশভ্যানে বড় বড় বাঁশের ঝাঁকায় গাদা গাদা মাছ উঠবে, পাকা রুই, চিতল-আড়, বর্ষাকালে নদীর উজ্জ্বল শস্য ইলিশ বাঙালি রসনার প্রধান উপাদান।
সে যা হোক, এ রেলগাড়ির যাতায়াত ছিল চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া রূপকথার জগৎ নিয়ে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র ভুবন থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’-এর পৃথিবী এই রেলপথের চারপাশে। ধলেশ্বরী নদীতীরে পিসিদের গ্রাম, সেই গ্রাম সিরাজগঞ্জের নদীর ওপারেই। এ অঞ্চলে ধলেশ্বরী যমুনার সহচরী।
রেললাইন সিরাজগঞ্জেই শেষ। সিরাজগঞ্জে তিনটি স্টেশন। সিরাজগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ বাজার এবং সিরাজগঞ্জ ঘাট। প্রথম দুটি স্থায়ী স্টেশন। তৃতীয়টি নদীর মুখে, নদীর সঙ্গে এগোয় আর পিছোয়।
সিরাজগঞ্জের পর শুধু নদী আর নদী। ছোট নদী, বড় নদী, নালা, খাল, বিল। সেসব বিল হ্রদের মতো অতিকায়, কোথাও কোথাও বলা হয় হাওড়। পুরোটাই জলের এলাকা। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি দূরের কথা, ঘোড়ার গাড়ি, গোরুর গাড়ির রাস্তাও বিরল। রিকশাও ছিল না, দুয়েকটা টুং টাং সাইকেল, ডুলি, পালকি। বড় জোর এক ঘোড়ার টমটম গাড়ি।
স্থলপথে সত্যিই তেমন কোনও বাহন ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না।
শুধু জল আর জল। শরীরের শিরা উপশিরার মতো চারিদিকে ছড়ানো নদী, উপনদী, শাখানদী, তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। দু’দিকের দুটি নদীকে যুক্ত করেছে মানুষের তৈরি খাল। সেইসব জলে নানা আকারের নানা প্রকারের নৌকা, ছোটবড় ডিঙি থেকে পানসি পর্যন্ত, বাঁশের খোলে ঢাকা ছোট ঢাকাই নৌকো থেকে প্রকাণ্ড বজরা, মানোয়ারি তরী।
ট্রেন থেকে সিরাজগঞ্জে নেমে আমাদের সময়ে অবশ্য স্টিমার ছিল। শীতে-বর্ষায় নদী পিছোত, এগোত। স্টিমার ঘাটও সেইসঙ্গে এগিয়ে যেত পিছিয়ে আসত। সিরাজগঞ্জ ঘাট রেলস্টেশনও তাই।
তখন কলেজে গরমের ছুটি হত মে-জুন এই দুই মাস। কলেজে পড়ার সময়ে মে মাসের প্রথমে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন ট্রেন থেকে নেমে বাক্স-বিছানা নিয়ে প্রায় একমাইল হাঁটতে হত স্টিমারে ওঠার জন্যে। আবার এর পরেই ভাদ্রের শেষে যখন পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরতাম তখন সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী টইটম্বুর। ট্রেন থেকে নেমে অল্প দূরে স্টিমার।
আগের দিন সন্ধ্যাবেলা শেয়ালদা স্টেশন থেকে সুরমা মেলে পরের দিন সকালে সিরাজগঞ্জ ঘাটে এসে স্টিমার ধরতে হয়।
সিরাজগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ জেলায় দু’দিকে স্টিমার যেত। একটা রেল কোম্পানির স্টিমার। অতিকায় জাহাজের আকারের। সিরাজগঞ্জ থেকে জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত স্টিমার, সেখানে গিয়ে আবার রেলগাড়ি, যার যাত্রাপথ ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত। এই স্টিমারের টিকিটের দাম রেলের টিকিটের সঙ্গেই নিয়ে নেওয়া হত। গোয়ালন্দ থেকে ঢাকা প্রাইভেট স্টিমার সার্ভিসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রেল কোম্পানি সিরাজগঞ্জ-জগন্নাথগঞ্জ স্টিমার চালাত।
কোনও বিশেষ কারণ না ঘটলে আমরা ওই জগন্নাথগঞ্জের স্টিমারে কালেভদ্রে চড়েছি। বাড়ি ও-পথেও যাওয়া যেত, কিন্তু আরও একদিনের ঝামেলা। স্টিমারে ওই জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে বিকেলে নেমে ময়মনসিংহ ট্রেনে পৌঁছতে সন্ধ্যা। সেখানে রাত্রিবাস। পরের দিন সকালে ডাক ধরে দুপুর নাগাদ টাঙ্গাইল।
আমাদের ছিল ছোট স্টিমার। জগন্নাথগঞ্জের স্টিমারের মতো তার লক্ষ্য ঢাকা-ময়মনসিংহের মতো বিখ্যাত জায়গা নয়, সে স্টিমার যাবে চারাবাড়ি, পোড়াবাড়ি। অবশ্য তার আগে পটল।
সবসময়ে যে স্টিমারে যেতাম তা নয়। অনেক সময় স্টিমার থাকত না। সে ছিল ভাড়াটে স্টিমার। কখনও বিয়ের বরযাত্রী নিয়ে চলে যেত কিংবা কোনও নদীর চরের গ্রামে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে পুলিশ, ম্যাজিষ্ট্রেট রিকুইজিশন করে নিয়ে যেত। আবার অনেক সময় সারাই হতে ঢাকা-কলকাতা পাঠানো হত।
তখন লঞ্চ চলত। বেশ বড়, ফেরি লঞ্চ। ফার্স্ট ক্লাস আর থার্ড ক্লাস। সেকেন্ড ক্লাস ছিল না।
দোতলায় সারেঙ সাহেবের ঘরের সামনে একটু ঢাকা জায়গা, সেখানে কয়েকটা কাঠের চেয়ারের সঙ্গে একটা ছোট টেবিল। সেটা ফার্স্টক্লাস। বাকি আর সব থার্ড ক্লাস।
অনেক সময় এই লঞ্চও থাকত না। তখন গহনার নৌকো। গহনার বা গয়নার নৌকো, এর মানে কী জানি না। আসলে এটা ছিল বিশাল আকারের শক্ত, সমর্থ, ভাল করে বাঁশের ছই দেওয়া যাত্রী নৌকো। প্যাসেঞ্জার বোট। আজকাল যেমন প্যাসেঞ্জার বাস তেমনি প্যাসেঞ্জার বোট।
সিরাজগঞ্জ ঘাটের বাঁক থেকে যত দূরেই তাকাই কুল-কিনারা দেখা যেত না। গহন, উত্তাল নদী। এপারে সিরাজগঞ্জ, ওপারে টাঙ্গাইল। মধ্যে অতল অকূল জল।
প্রথম স্টিমার স্টেশন পড়ত পটল। পুরনো দিনের বর্ধিষ্ণু গ্রাম। দু’-চারজন লোক, যারা কলকাতার দিক থেকে গ্রামে আসছে তারা নামত। আবার যাদের টাঙ্গাইল শহরে মামলা-মোকদ্দমা, কেনা-কাটা আছে তারা উঠত।
এরপরে পোড়াবাড়ির ঘাট। পূর্ববঙ্গের জলপথে যারা যাতায়াত করেছেন পোড়াবাড়ি নামটি তাদের কাছে বহু পরিচিত এখানকার বিখ্যাত মিষ্টির কারণে, যা পোড়াবাড়ির চমচম নামে বিখ্যাত।
আমরা দেশের বাড়ির কাছে এসে গেছি। স্টিমার বা লঞ্চ টাঙ্গাইল পর্যন্ত যাবে না। টাঙ্গাইল শহরের পাশ দিয়ে যে ছোট নদী গেছে, লৌহজঙ্গ, তাতে জল কম, সে জলে নৌকো চলে কিন্তু স্টিমার আটকিয়ে যায়, ফেরি লঞ্চও সাবলীলভাবে যেতে পারে না।
অবশ্য কোনও কোনও বছর বেশি জল হলে অথবা সিরাজগঞ্জ থেকে যদি আমরা গয়নার নৌকোয় করে আসতাম তা হলে সরাসরি টাঙ্গাইল ঘাটের পাশে মানদায়িনী সিনেমাহলের ঘাটে নামতাম।
এ রকম অবশ্য কদাচিৎ হয়েছে।
সাধারণত আমরা চারাবাড়ি হয়েই নামতাম। সিরাজগঞ্জের স্টিমার ওখানেই শেষ।
চারাবাড়ি ঘাটে লণ্ঠন নিয়ে অনেক লোক দাঁড়িয়ে, তারা তাদের বাড়ির লোক নিতে এসেছে।
আমাদের জন্যেও নিশ্চয়ই কেউ এসেছে।
অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি, হুড়োহুড়ি করে আমরা নেমে আসি ঘাটে। অতুলবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, অতুলহরি দত্ত, আমাদের মুহুরিবাবু, ফিটফাট পরিচ্ছন্ন ভদ্রলোক।
অতুলবাবু সঙ্গে রাধু গাড়োয়ানের ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসেছেন। এক-ঘোড়ার গাড়ি, আমাদের অঞ্চলে বলে টমটম গাড়ি।
রাধু গাড়োয়ানকে তো ছোটবেলা থেকে চিনি। এই টমটম গাড়িটা, এই ঘোড়া পর্যন্ত আমার চেনা।
এবড়ো-খেবড়ো কাঁচামাটির রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি রওনা হল। বাক্স-বিছানা নিয়ে আমি গাড়িতে উঠে বসার পর অতুলবাবু ঘাট থেকে বড় এক হাঁড়ি চমচম কিনে এনেছেন। সেই হাঁড়িটা কোলে নিয়ে তিনি আমার পাশে বসেছেন।
নদীর ধারের পথ ছেড়ে আমরা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের রাস্তায় উঠলাম। সামনেই টাঙ্গাইল শহর।
অবশেষে আমরা বাড়ি এসে গেছি।
আমরা থাকব বলেই পুরনো দালানের বাইরের বারান্দায় একটা ডে-লাইট জ্বালানো হয়েছে। বারান্দায় একটা তক্তপোশ তার ওপরে শীতলপাটি, একটা ইজিচেয়ার। মা-বাবা-পিসিমা বাড়ির আর সবাই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
যদি বাড়ির কথা ঠিকমতো বলতে হয়, তা হলে বলতে হবে আমাদের দুটো দেশের বাড়ি ছিল, একটা বাড়ি, আর অন্যটা বাসাবাড়ি।
আমাদের বাসাবাড়ি টাঙ্গাইল
আর বাড়ি এলাসিন। সেটাই আসল বাড়ি।
সেকালের আদালতের ভাষায়,
সাকিন এলাসিন
হাল সাকিন টাঙ্গাইল।
মনে পড়ছে, সংক্ষিপ্ত করে লেখা হত,
সাং এলাসিন
হাং সাং টাঙ্গাইল।
এলাসিনের কথা পরে কখনও বলব। আপাতত এলাসিন সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে এলাসিনে আমাদের গ্রামের বাড়ি। ষোড়শ কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীতে মগ, মোগলের অত্যাচারে কিংবা তারও কিছু পরে, বর্গির হামলার ভয়ে আমরা যশোহর অঞ্চল থেকে মধ্য-বাংলার নদী-নালা দিয়ে ঘেরা সুরক্ষিত, সমতল এবং উর্বর কৃষি অঞ্চলে চলে আসি। আমাদের মতোই আরও অনেক পরিবার নদীর তীরে বিভিন্ন গ্রামে নতুন আস্তানা পাতে।
একটা পুরনো গ্রামের বাড়ি, সেটা হল আসল বাড়ি। আরেকটা শহরের পাকাবাড়ি।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন বাংলার মফস্বল শহরগুলির পত্তন হল জেলা ও মহকুমা সদর হিসেবে তখন থেকেই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত কিছু পরিবারের দুটো করে বাড়ি। একটা গ্রামে, একটা শহরে। সে শহর অবশ্য কখনও কখনও কলকাতা নগরীও হতে পারে। শহরের বাড়িটা বাসাবাড়ি।
সে যা হোক এই মুহূর্তে আমাদের টমটম গাড়ি টাঙ্গাইল বাড়ির উঠোনে এসে থেমেছে।
বাড়িসুদ্ধ লোক উঠোনে এসে ভিড় করে দাড়িয়েছে। আশেপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন এসেছে। বেশ হইচই ব্যাপার।
আমাদের বাড়ি শহরের সবচেয়ে আয়তনে বড় বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল পুকুর। সেটা অবশ্য আমাদের নয়। মিউনিসিপ্যালিটির। কিন্তু সেই পুকুরের জন্য বাড়িটাকে আরও বড় মনে হয়। পুকুরের ওপারের বাড়িগুলোর আলো সেইসঙ্গে জোনাকির সতত সঞ্চারমান ছায়া ঢেউয়ের সঙ্গে দুলছে।
আশ্বিন মাস। দুয়েকদিন পরেই পুজো। আসার সময় দেখে এসেছি, কালীবাড়িতে হ্যাজাক জ্বালিয়ে কুমোরেরা দ্রুত কাজ সারছে।
বাতাসে একটু হিম হিম ভাব। নারকেল পাতার মধ্যে ঝিরি ঝিরি বাতাস। সারা বাড়ি ছেয়ে আছে ঝরা শেফালির গন্ধে। একটু পরে রাতের দিকে চারদিক নিস্তব্ধ হতেই গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাবে।
বাড়ির সামনের দিকে কাছারি ঘর। আমাদের ব্যবহারজীবি বংশ, পুরুষানুক্রমে আমার বাবা পর্যন্ত সবাই উকিল। কাছারি ঘরের বারান্দায় মক্কেলরা বসে রয়েছে। তাদের দুয়েকজন হয়তো আমাদের বাড়িতে থাকবে।
একেবারে পূর্বদিকে একটা বিশালাকার কাঠের দোতলা ঘর। আগে মুহুরিবাবুরা এবং অতিথিরা থাকতেন, এখন সেটায় একটা পাঠশালা বসে। সেই পাঠশালায় একদা আমিও পড়েছি।
সামনে আমাদের পুজোর দালান। ঘরের পর ঘর। থাম লাগানো আট হাত চওড়া টানা বারান্দা পুরো দালানটাকে ঘিরে। আমাদের ভাষায় বাইরের বারান্দা আর ভিতরের বারান্দা। দুই বারান্দায় একসঙ্গে আড়াইশো লোক পাতা পেড়ে খেতে পারে।
বাইরের উঠোন থেকে লম্বা, টানা সিঁড়ি উঠে গেছে বারান্দায়। ভিতরের দিকে গোল সিঁড়ি। একটু সামনে পর পর তিনটে টিনের ঘর।
বড় ঘরটায় থাকতেন আমার পাগল কাকা, তারপর সমান আকারের দুটো দোচালা টিনের ঘর। একটা হবিষ্যি ঘর, একটা রান্নাঘর।
হবিয্যি ঘর, রান্নাঘরের পিছনে পুরনো ফুলবাগান। জবা, শেফালি, রঙ্গন, টগর, কাঠচাঁপা, অযত্নের গোলাপ।
বাড়ির চারপাশে কত রকমের গাছ। আম, কাঁঠাল, সুপুরি, নারকেল তো আছেই কামরাঙ্গা, চালতে এমনকী সেই আমলের পক্ষে অস্বাভাবিক দুটি ইউক্যালিপটাস গাছ।
ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে পুরো বাড়িটা একবার পাক দিয়ে আসি। ততক্ষণে ডে-লাইটটা বাইরের বারান্দা থেকে রান্নাঘরের বারান্দায় নিয়ে আসা হয়েছে।
একটু পরে পুকুরের ঘাটে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর কাপড়-চোপড় ছেড়ে গোলবারান্দায় গিয়ে ভিতরের উঠোনে নেমে এসে দেখি চারদিক ম-ম করছে গরম ভাতের গন্ধে। একটু পরে মাছ-ভাজার গন্ধও পাওয়া গেল।
ওপাশে ফুলবাগানের পাশে তুলসীমঞ্চে সলতে ফুরিয়ে গিয়ে প্রদীপের বুকটা পুড়ে যাচ্ছিল। একটু এগিয়ে গিয়ে একটা কাঠি দিয়ে প্রদীপের সলতে উসকিয়ে দিলাম।
এরই মধ্যে রান্নাঘরের বারান্দায় সারি সারি কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পাতা হয়ে গেছে। এখনই সবাইকে খেতে ডাকা হবে। দু’বেলা ভাত খাওয়া হয়নি। আমি ডাক পাড়ার আগেই বারান্দায় গিয়ে পিঁড়ির ওপরে বসে পড়ি।
একটা টিকটিকি দালানের বারান্দা থেকে আমাকে সায় দেয়, ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক।’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন