বহু আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ট্রেন্ড ছিলো; আপনার জীবন বদলে দেয়া ১০টি বই। সেই চিন্তাতেই শুরু করলাম। হোক না ১০ বছর পরে, তাতে কী, ট্রেন্ড তো! শুরুতেই মনে হলো, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা। তারপর মনে হলো এই বই পড়তে সুখপাঠ্য, ভাবনারও খোরাক আছে। কিন্তু আমার জীবনে বন্ধুদের সাথে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে সহায়তা করা ছাড়া এর আর প্রভাব কী? কাজেই সেটা বাদ! সত্যি সত্যিই জীবনে প্রভাব ফেলেছিলো এমন দশটা বইয়ের কথা আলোচনা করা যাক...
১. শোধ: তসলিমা নাসরীন
এর প্রভাব: ক্লাস টু'তে পড়ার সময় বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম। আমার সেই অপরিণত বয়সে দারুন 'পরিণত' সেই উপন্যাস একলাফে টোনাটুনির গল্প থেকে 'সেই জীবনে' পরিচয় ঘটিয়ে দিলো। সেই জন্য লেখিকার প্রতি আমার প্রবল অভিমানবোধ জন্ম নিলো। রাতের বেলায় খাবার টেবিলে এই ধরনের বইয়ের কুফল সম্পর্কে গুরুগম্ভীর মতামত রাখলাম। আব্বা-আম্মাসহ সবাই হতস্তম্ভিত! ফলাফল হিসেবে ছয়মাস আমার বাড়িওয়ালার বাসায় যাওয়া নিষিদ্ধ করা হলো।
২. তিন গোয়েন্দা: রকিব হাসান
এর প্রভাব: স্কুল বয়সে পাগলের মতো পড়তাম। একসময় বাসায় কাজের ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে গোয়েন্দা বাহিনী খোলা হলো। বাসায় শ'পাঁচেক টাকা হারানো গেলে আমরা প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নিজের থেকে নেয়া অ্যাসাইনমেন্ট। সন্দেহ আর কাকে করবো, যথারীতি কাজের বুয়া! সোফার ওপর কিছু টাকা ফেলে আমরা দুজন সোফার নিচে লুকিয়ে রইলাম। কিন্তু বুয়া ঘরে ঢুকে প্রথমেই সোফার নিচে ঝাড়ু দিতে উঁকি দেয়ায় রেড হ্যান্ড কট্। তারপর আমাদের রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দা কাহিনী ফাঁস এবং বুয়ার আকাশ ফাটিয়ে চিল্লাচিল্লি... আম্মার চিরুনির বাড়ি খেয়ে গোয়েন্দা ক্যারিয়ারের সেখানেই সমাপ্তি।
৩. চাচা-চৌধুরী: কার্টুনিস্ট প্রাণ
এর প্রভাব: চাচা-চৌধুরী সিরিজের একটা বইয়ে লেখা ছিলো, ঝাল খেলে দাঁড়ি-গোঁফ তাড়াতাড়ি ওঠে। দাঁড়ি-গোঁফ ওঠার প্রবল তাড়নায় ভাতের সাথে দুটো বোম্বাই মরিচ খেয়ে ফেললাম। তারপর ঝালের চোটে হু-হা কান্নাকাটি করে পাড়া তোলপাড় অবস্থা। সেই দুঃখেই কিনা এখনও নিতান্তই অনিচ্ছায় একটুখানি গোঁফ ওঠে। দাঁড়িবাবা জীবনে কবে দেখা দেবেন তা কেবল আল্লাহ জানেন!
৪. অন্যরকম একদিন: তারেক আজীজ
এর প্রভাব: স্কুল জীবনের বন্ধুর লেখা বই। সেটা লেখা হয়েছিলো স্কুলের কোন এক ক্লাসের মধ্যে বসেই! এই বই আমাদের বন্ধুদের সবার মধ্যেই এক নতুন তরঙ্গ জাগিয়ে তুললো। ভয়াবহ রকম অশ্লীল বই। এর প্রভাব বরং থাক...
৫. উন্মাদ, সংখ্যা ৫৫ (আহসান হাবীব সম্পাদিত)
এর প্রভাব: অক্ষর শেখার পর পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রথম কোন বই। এই পত্রিকা হাতের নেয়ার পর জীবনটাই এখন পর্যন্ত উন্মাদ-উন্মাদ হয়ে রইলো। সুস্থ হবার সুযোগ আর হলো কই?
৬. রান্না-খাদ্য-পুষ্টি: সিদ্দিকা কবীর
এর প্রভাব: এর প্রভাব সরাসরি আমার ওপর পড়েনি। পড়েছিলো আমার আম্মার ওপর। ফলাফল হিসেবে টেবিলে মাঝেমধ্যেই দেখা যেতো অসাধারণ কিছু এক্সপেরিমেন্ট। জীবনটাই তখন অন্যরকম মধুর মনে হতো।
৭. উন্মাদ, সংখ্যা ১২২ (আহসান হাবীব সম্পাদিত)
এর প্রভাব: এই সংখ্যা পড়ার পর আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এই অসাধারণ গ্রুপে আমাকে ঢুকতেই হবে। আমি লেখা পাঠালাম। হাতের লেখা বুঝতে পারলেন না দেখে উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবীব পরপর দুটা লেখা বাতিল করে দিলেন। আমি বাংলা টাইপিং শিখলাম। তারপর টাইপ করে তৃতীয় লেখা পাঠালাম। হাবীব ভাই সাদরে বরন করে নিলেন। তাঁর বাড়াবাড়ি প্রশ্রয়ে আমি মুক্তকচ্ছ হয়ে লেখালেখি আরম্ভ করলাম।
৮. নর-নারীর একান্ত সমস্যা: ডা: মিজানুর রহমান কল্লোল
এর প্রভাব: আমার চেনা-জানা যত বই আছে, এই বইয়ের মতো এতো বৈচিত্রময় আর নর-নারীর জীবনের গহীন একান্ত সমস্যার কথা আর কেউ লেখেননি! একেবারেই একলা পড়ার মতো বই, দ্বিতীয় কেউ দেখলেই ইজ্জত যাবার সম্ভাবনা! একবার মেলায় উন্মাদ পত্রিকার ছড়াকার অনিক ভাই গলায় মধু ঢেলে স্টল থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর এই বই কিনে গিফট করলেন। বললেন বইয়ের পাতায় নাম লিখতে। কারণ জিজ্ঞেস করায় বললেন, আমার নাকি বইয়ে নাম লেখার অভ্যেস নেই। অভ্যেস করানোর জন্য এই প্রজেক্ট। আমি গভীর আবেগ নিয়ে নাম লিখলাম, তারিখ লিখলাম। লেখার পরপরই অনিক ভাই সেই বই সিজ করে নিলেন। এখনও অনিক ভাইয়ের বাসায় গেলে সেই বই দেখতে পাওয়া যায়! কেউ আশ্চর্য হয়ে 'এই বই কার' জিজ্ঞেস করলে অনিক ভাই নির্দ্বিধায় আমার নাম বলে দেয়। তারপর বইয়ের পাতা খুলে আমার নাম দেখায়। লজ্জায় অনিক ভাইয়ের বাসায় যাওয়া প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হয়েছে!
৯. বাদশাহ নামদার: হুমায়ূন আহমেদ
এর প্রভাব: এই জাদুকরের লেখায় আমি বাদশাহ হুমায়ূন সিনড্রোমে আক্রান্ত হলাম। কিছুদিনের মধ্যে হুমায়ূন পত্নী হামিদার মতো কাকতালীয় ভাবে আমার জীবনেও হামিদা নামে একজন আসলেন। ব্যস, আমার জীবনে মিল এই পর্যন্তই। হামিদার জীবনে আরও মিল ঘটলো। সম্রাট নামে একজনের সাথে বিয়ে করে তিনি ভেগে গেলেন। আমি দুঃখে বাদশাহ নামদার বইটা শেলফের পিছনের তাকে তুলে রাখলাম।
১০. প্রথম আলো: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এর প্রভাব: সবার জন্মদিনে বন্ধু-বান্ধব চাঁদা তুলে খুব সুন্দর জামা-কাপড় দেয়ার রেওয়াজ ছিলো। সবার জন্য চাঁদা দিতে দিতে ফতুর হবার সময় ভাবতাম একদিন গিফট পাবো আমিও... জন্মদিন আসলে গিফট খুলে দেখি সুনীলের দুই খণ্ড প্রথম আলো! কারণ হিসেবে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আলাপ শুনে মনে হয়েছে আমি নাকি খুব পড়ুয়া। তাই গিফট হিসেবে বই! এরপর আমি সাবধান হয়ে গেলাম, বন্ধুদের সাথে আলাপে বসলেই আড়ং-কে ক্র্যাফট-গ্রামীণ চেক ছাড়া আর কোন কথা নেই। ফলফলও মিললো পরের জন্মদিন। ধন্যবাদ প্রথম আলো।
আপনার জীবনের এমন দশটি বয়ের তালিকা কী? কমেন্টে জানাইয়েন প্লিজ…
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন