সাহিত্যের রূপ ঠিক কিরকম হতে পারে সে নিয়ে হয়তো আলোচনা পর্যালোচনা চলতে পারে। তবে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে বলা যায় সাহিত্য শুধু একরূপই হতে পারে। যার শুরুতে থাকবে সুভানাল্লা আর শেষে আলহামদুলিল্লাহ। আর মাঝখানের পুরোটা বাঁধা থাকবে একটা লাইনের মাঝে। লাইনের বাইরে গেলেই কোপ। দেশের বখে যাওয়া নাস্তিক মুরতাদ সাহিত্যিকরা হয়তো ভেবে ভেবে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলছেন, কিভাবে লাইনে থেকে জান বাঁচানো যায় এই নিয়ে। তাদের জন্যই আমার আজকের এসো নিজে করি, কিভাবে সহিহ সাহিত্যিক হবেন। থুক্কু, এটা আসলে এসো নিজে করি নয়। এটাকে বরং পাঠ প্রতিক্রিয়া বলা যায়। সদ্য পড়া কাসেম বিন আবুবাকারের 'ফুটন্ত গোলাপ' এর পাঠ প্রতিক্রিয়া। সন্দেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখতে বসে মনে প্রশ্ন জাগলো, গত বছরে আমার আবিষ্কার করা লেখক এবং লেখা কোনটি। উত্তর এক নিমিষে পেয়ে গেলাম, কাসেম বিন আবুবাকার এবং তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'ফুটন্ত গোলাপ'।
শুরুতেই প্রশ্ন জাগতে পারে কাসেম বিন আবুবাকার কে? এই প্রশ্নের উত্তর দিব, আপনি কে? কে আপনি যে এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম জানেন না? যদি ভেবে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক তবে সেটা সম্পূর্ণ ভুল। কাসেম বিন আবুবাকার এর বই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী বিক্রিত (বা বিকৃত) বই। তার কালজয়ী উপন্যাস 'ফুটন্ত গোলাপ' এর সংস্করণ বের হয়েছে ত্রিশ এর অধিক। চট করে মনে করে দেখুন তো হুমায়ূন আহমেদ এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রিশ এর অধিক সংস্করণ হওয়া বই কয়টি। আর বেশী ভ্যাজর ভ্যাজর না করে পাঠ প্রতিক্রিয়া শুরু করি।
উপন্যাসের ছোট্ট ভূমিকাতেই লেখক উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সমাজের চরম অবনতি উপলব্ধি করেই তিনি এই উপন্যাস রচনা করতে উৎসাহী হয়েছেন। তার ভাষাতেই বলি, আমার মনে হয়েছে এভাবে যদি দিন দিন আমরা প্রগতি ও নারী স্বাধীনতার নাম নিয়ে চলতে থাকি...(তাইলে খবর আছে)। বিদেশি শিক্ষার সংগে সংগে তাদের ভালো দিকটা বাদ দিয়ে খারাপ দিকটা অনুসরণ করে আমরা যেন 'কাকের ময়ুর হওয়ার মতো' মেতে উঠেছি...(ইত্যাদি ইত্যাদি)। সেই সাথে এও বলেছেন, “যদি এই বাস্তবধর্মী উপন্যাস পড়ে বর্তমান যুবক সমাজ সামান্যতম জ্ঞান লাভ করে সেইমতো চলার প্রেরণা পায়, তবে নিজেকে ধন্য মনে করবো”। ঠিক একারণেই বখে যাওয়া যুবক সমাজ আকা নাস্তিক বলগারদের জন্য অত্যন্ত জরুরী তার বই পড়া। এই উপন্যাসের প্রতি পদে পদে আছে শিহরণ, আছে জ্ঞান, আছে লাইনে চলা এবং থাকার উপায়।
উপন্যাসের প্রথম পাতাতেই আমরা দেখতে পাই নায়িকা লাইলীকে লাইব্রেরীর সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে নায়ক সেলিমের সাথে ধাক্কা খাবার দৃশ্য। দৃশ্যটি পরিচিত এবং প্রায় সমস্ত বাংলা হিন্দি সিনেমায় অবস্থিত মনে হলেও রচনাশৈলীর কারণে সেই সাধারণ দৃশ্যটি অসাধারণ হয়ে উঠেছে। ধাক্কা খেয়ে লাইলীর মনের অবস্থা লেখক অসাধারণ দক্ষতার সাথে চিত্রিত করেছেন এভাবে--
"ইয়া আল্লাহ একি হল বলে লাইলী কি করবে ভেবে না পেরে সেলিমের দীর্ঘ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য ও পৌরুষদীপ্ত চেহারার দিকে লজ্জামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সব কিছু ভুলে গেল।"
সেলিমের স্বাস্থ্য যদি দীর্ঘ বলিষ্ঠ না হতো আর লাইলী যদি আজকালকার ফটকা যুবতী হতো তবে হয়তো ধাক্কা খেয়ে সে বলে বসতো, ধুর বা*। কিন্তু লাইলী তো সেরকম বখে যাওয়া যুবতী নয়। একইভাবে আজকালকার ফটকা লেখকরা হয়তো শর্টকাটে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফেলতেন, সেলিমের সাথে ধাক্কা খেয়ে লাইলীর অর্গাজম হয়ে গেল। কিন্তু লেখক সেরকম চটুল ভাষায় না গিয়ে সহজ অথচ অলঙ্কার পূর্ণ ভাষায় লাইলীর ধাক্কা খাওয়া, মজনুর আই মিন সেলিমের স্বাস্থ্য ও যৌবন এবং সেই যৌবনকে দেখে লাইলীর 'কিরাম কিরাম লাগার' চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই তো গেল লাইলীর অবস্থা। এর পরের প্যারাতেই লেখক সেলিমের অবস্থা বর্ণনা করেছেন--
"আর সেলিম তার দিকে চেয়ে খুব অবাক হল। এত রূপ যে কোন মেয়ের থাকতে পারে, সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। লাইলীর টকটকে ফর্সা গোলগাল মুখটা শুধু দেখা যাচ্ছে। কারণ সে বোরখা পরে আছে।"
আবারও বলি, কোন চটুল লেখক হলে শর্টকাটে বলে ফেলতেন, লাইলীকে দেখে সেলিমেরও ইয়ে হয়ে গেল। কিন্তু লেখক সেই ছোট রাস্তায় না হেঁটে অসাধারণ রচনাশৈলী দিয়ে বর্ণনা করেছেন বোরখা পরা লাইলীর সৌন্দর্যকে। শুধু তার গোলগাল ফর্সা মুখ দেখেই সেলিমের যেভাবে ইয়ে হয়ে গেল, আর কিছু দেখলে হয়তো মাল্টিপল ইয়ে হয়ে যেত। কিন্তু সে লাইনে না যাই বরং। এদিকে পরে যাওয়া বই তুলতে গিয়ে লাইলীর হাত ঠেকে যায় সেলিমের হাতে। আবারও ইয়ে হয়ে যায়। আঁতকে উঠে লাইলী 'হায় আল্লাহ' বলে নিজের হাত টেনে নিয়ে লজ্জায় দৌড় দেয়। আর সেলিম মনে মনে ভাবে--“এত নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে এই প্রথম সে দেখল। মেয়েটি যেন একটা 'ফুটন্ত গোলাপ'।”
এই যে হয়ে গেল! উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা প্রথম পাতাতেই পেয়ে গেলাম আমরা। একশত ভাগ সহিহ লোকেরা নারীদেরকে সবসময় নানা ফুল ফল ও খাবারের নাম দিয়ে সম্মানিত করেন। তাই ফুল, গোলাপ, কলি, ফুটন্ত গোলাপ, তেঁতুল থেকে শুরু করে লজেন্স পর্যন্ত নানা বিশেষণে নারীরা বিশেষিত হয়। সেই ধারাতে ফুটন্ত গোলাপ অবশ্যই চমৎকার এবং প্রাসঙ্গিক নামকরণ। সেই সাথে মনে হয় 'ফুটন্ত গোলাপ' না হয়ে নামটা 'গাছন্ত তেঁতুল' বা 'প্যাকেটের লজেন্স' হতে পারতো। তবে ভাষাশৈলী বিবেচনা করে 'ফুটন্ত গোলাপ' আরও বেশী সুন্দর নাম।
এতক্ষণ পর্যন্ত উপন্যাস মাত্র প্রথম পাতার অর্ধেক পর্যন্ত এগিয়েছে। বাকি আছে আরও একশত ত্রিশটি পাতা। কিন্তু এই আধা পাতাতেই ঘটনা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। ঘটনা আরও খানিক আগালে আমরা জানতে পারি সেলিম সম্পর্কে। সেলিম একজন খুব ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। জুডো, কারাত এবং বক্সিং-এ পারদর্শী। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে। তাদের দুটো গাড়ি। অন্যটির জন্য একজন শিক্ষিত ড্রাইভার আছে। বন্ধু-বান্ধবী আত্মীয়, অনাত্মীয় ও ভার্সিটির কত মেয়ে যে তার পেছনে জোঁকের মতো লেগে থাকে। অপরদিকে লাইলীরা বড়ই গরীব। লাইলী আর সেলিমের মিল শুধু এক জায়গায়। তারা দুজনেই নিজ নিজ ক্লাসে ফার্স্ট হয়। লাইলী ক্লাস এইট, নাইন, টেন সব পরীক্ষা থেকে শুরু করে আইএ-তে সব বোর্ডের সব গ্রুপের মধ্যে ফার্স্ট। সম্ভবত দেশের ইতিহাসের প্রথম ছাত্রী যে ম্যাট্রিক ইন্টার সবখানে ফার্স্ট হয়ে এখন ইসলামিক ইতিহাসে অনার্স করে। এবং স্বাভাবিকভাবেই ইসলামিক হিস্ট্রিতে অনার্সের সব ক্লাসেও সে ফার্স্টই হয়। অন্যদিকে সেলিম স্ট্যাটিস্টিকস এ অনার্স পড়ে এবং স্বভাবতই সেখানে সে ফার্স্ট হয়। এই ফার্স্ট হওয়া ছাড়া বাকি সব অমিল আর অমিল। সেলিম বিশাল বড়লোকের ছেলে। বিশাল অভিজাত। এতই অভিজাত যে সে কলিংবেলও বাজায় অভিজাতভাবে। লেখকের বর্ণনায় লাইলীর বাড়িতে গিয়ে সেলিমের কলিংবেল বাজানো ফুটে উঠেছে, “ঠিক এমন সময় কলিং বেলটা বিরতি দিয়ে দু’বার বেজে উঠলো। কলিংবেল বাজার মধ্যেও যেন আভিজাত্য আছে।”
সামান্য কলিংবেল বাজানো লেখকের বর্ণনায় অসামান্য হয়ে উঠেছে। একটু চিন্তা করলেই আমরা সত্য বুঝতে পারি। মধ্যবিত্ত কলিংবেল বাজায় এভাবে, পিড়িং পিড়িং (২ সেকেন্ড বিরতি) পিড়িং পিড়িং। কলিংবেল বাজানোর মধ্যে তার অস্থিরতা ও অনাভিজাত্য ফুটে ওঠে। ফকিররা কলিংবেল বাজায় ভয়ে ভয়ে, আরও বিরতি দিয়ে, পিড়িং (দশ সেকেন্ড) পিড়িং। অন্যদিকে সেলিমের আভিজাত্য ফুটে ওঠে পিড়িং (ছয় সেকেন্ড) পিড়িং করে একেবারে উপযুক্ত বিরতি দিয়ে কলিংবেল বাজানোর মধ্য দিয়ে। যাইহোক, অন্যদিকে লাইলী গরীব ঘরের, বাবা কেরানি। লাইলী ধর্মপ্রাণ। সেলিম তেমন ধর্মকর্ম করেনা। ঠিক ধরেছেন, উপন্যাসের শেষে গিয়ে লাইলী ঠিকঠিক সেলিমকে লাইনে নিয়ে আসবে।
উপন্যাস আরও আগালে আমরা লাইলী সম্পর্কে আরও জানতে পারি। জানতে পারি, লাইলী চা বা কফি কিছু খায় না। শুধু দুধ খায়। একটু আগে আমরা জেনেছি সেলিম কিভাবে কলিংবেল বাজায়। এবারে জেনে নেই লাইলী কিভাবে দুধ খায়।
সেলিমের মা জিজ্ঞেস করে, চা বা কফি কিছু খাবে?
জি না বলে লাইলি দুধের গ্লাসটা দুহাতে ধরে মুখের কাছে নিয়ে প্রথমে বিসমিল্লাহ বলে এক ঢোক খেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলল। দ্বিতীয়বারও তাই করল এবং শেষ বারে সবটা খেয়ে আবার আলহামদুলিল্লাহ বলল।
মাত্র দুটি লাইনে লেখক লাইলির দুধ খাওয়ার বর্ণনার মধ্য দিয়ে কত কিছুই না ফুটিয়ে তুলেছেন। এই মাত্র দুটি লাইন থেকে আমরা জানি--
- চা/কফি খাওয়া মেয়েছেলেদের জন্য ভালো কিছু নয়।
- হ্যাঁ বা না এর আগে জি বলতে হয়।
- দুধের গ্লাস বা যে কোন গ্লাস দুই হাতে ধরতে হয়।
- দুধ সবসময় এক ঢোঁক এক ঢোঁক করে খেতে হয়।
- প্রতি ঢোঁকের শুরুতে বিসমিল্লাহ ও শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়।
সে যাই হোক, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছি। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কেন লাইলী সেলিমের বাড়িতে এসে দুধ খাচ্ছে। আরেকটু পিছিয়ে যাই। লাইলীকে খুঁজে পাবার জন্য সেলিম হাজির হয় মিলাদুন্নবির এক মাহফিলে। সেখানে গিয়ে কবিতা পড়ে,
প্রিয়তমা, ও আমার ভালবাসার সৌগন্ধময় প্রিয়তমা,
বড় আশা নিয়ে এসেছি এখানে, তুমি আছ কিনা জানিনা।
তবু অ্যাজ আমি শোনাব তমায় আমার মর্মবেদনা,
ও বাতাস পৌঁছে দিও তার কানে আমার কামনা ও বাসনা।
...
আল্লাহগো তুমি দেখা করে দিও আমার প্রেয়সির সনে।
ওগো প্রিয়তমা, সত্যিই যদি এসে থাক এই শুভ মাহফিলে,
তা হলে পিপাসা আমার মিটিয়ে দিও সব শেষে দেখা দিয়ে।
কবিতা শুনে সৌগন্ধময় লাইলীর আবারও ইয়ে হয়ে যায়। সেলিমের সাথে একটু খুনসুটি হয়। এর পরের সিনেই আমরা দেখতে পাই লাইলীকে কিছু গুণ্ডা তাদের জিপে তুলে ফেলে। লাইলীর চিৎকার পাশ থেকে এক প্রাইভেট কারের ড্রাইভার শুনতে পায়। সে ড্রাইভার আর কেউ নয়, সেলিম নিজে। লেখক চতুরতার সাথে আমাদেরকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন সেলিম নিজের গাড়ি নিজেই চালায় আর সেলিম জুডো, কারাত, বক্সিং আর ফুটবলে পারদর্শী। তাই এর পরে কি হতে পারে সেটা আমরা খানিকটা অনুমান করতে পারি। সেলিম চার গুণ্ডাকে প্যাদিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়। তারপর, খবরদার আর কখনও এরকম কাজ করবেনা বলে তাদের তাড়িয়ে দেয়। এরপর সেলিম আর তার মাতা মিলে লাইলীকে উদ্ধার করে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। তারপরেই লাইলী দুধ খায়।
সেলিম আর লাইলীর কথোপকথনে মাঝেমাঝেই “নারীর সঙ্গে দেখা হবে রুটি বেলার কাঠে, কাপড় কাচার ঘাটে, রাইতের বেলা খাটে। এর বাইরে আর কুথাও নারী দেখলেই মাইর” এর বিষয়টি উঠে এসেছে। যেমন একদা সেলিম লাইলীকে মেয়েদের প্রধান ধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, "আমি তো জানি মেয়েদের প্রধান ধর্ম হল, স্বামীকে সব বিষয়ে অনুসরণ করা এবং তার প্রত্যেক কথা ও কাজে সম্মতি দিয়ে সেই মতো করা।"
লাইলী বলে, "আপনি ঠিকই জানেন। তবে অর্ধেকটা। বাকি অর্ধেকটা হল, স্বামী যদি স্ত্রীকে আল্লাহ ও রসুলের আইনের বাইরে কোন কাজ করতে বলে তাহলে সে স্বামীর আদেশ অমান্য করে আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ মানবে।"
একইভাবে লাইলীর সাথে তার সখী সুলতানার কথোপকথনে উঠে আসে নারী স্বাধীনতার নামে উলঙ্গপনা করার বিষয়টি।
“বর্তমান যুগের নররা দিব্যি মাথায় হ্যাট, গলায় নেকটাই, পায়ে মোজা এবং ফুলপ্যান্ট ও ফুলশার্ট পরে শরীরের কোন অংশই মেয়েদের দেখাতে চায়না। অপরদিকে নারীকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় সাথে সাথে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নারীদের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, তারা জাঙ্গিয়া ও বেসীয়ার পরে বেড়াতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আর সেই কারণে পৃথিবীর সব দেশে মেয়েদের কদর কমে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ রাসুল (দঃ) মেয়েদের কিমতি (দামী) জিনিস বলে উল্লেখ করেছেন। একটু বিবেচনা করলে বুঝতে পারবেন। কেউ দামী জিনিসকে যেখানে সেখানে উন্মুক্ত করে ফেলে রাখে না। ফেলে রাখলে তার কি অবস্থা হবে সবাই জানে। ভালো জিনিস দেখলে কার না লোভ হবে। যেই সুযোগ পাবে সেই হাত বাড়াবার চেষ্টা করবে। ফলে নানারকম অশান্তি সৃষ্টি হবে। নারী স্বাধীনতার নাম করে করে মেয়েরা যে সর্বক্ষেত্রে পর্দা না মেনে যত্রতত্র অবাধ বিচরণ করছে, তার ফলাফল যে কত বিষময়, তা তো অহরহ গ্রামে গঞ্জে ও শহরে এবং খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি।”
প্যাকেট ছাড়া লজেন্স অথবা পাহারাদার ছাড়া তেঁতুল গাছ অথবা সিন্দুক ছাড়া গয়না ফেলে রাখলে কি হতে পারে সেটা আমরা সবাই জানি। লেখক বারবার আমাদেরকে সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে দেশের মেয়েরা জাঙ্গিয়া ও বেসীয়ার পরে ঘুরতে পারে এটা কল্পনা করে লেখক একই সাথে আনন্দে ও ভয়ে শিউরে উঠছেন। সেইসাথে ভালো জিনিস দেখলে যে কারোরই লোভ হতে পারে, সেটা লোভির দোষ নয় বরং জিনিসের দোষ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পেন্টি, ব্রা, বেসিয়ার, জাঙ্গিয়া এই শব্দগুলা এক বিশেষ শ্রেণীর সহিহ লোকজন বেশ আরামের সাথে উচ্চারণ করে থাকেন। শব্দগুলা উচ্চারণের সময় বস্তুগুলা কল্পনা করে তাদের চোখ আমোদে বুদ হয়ে যায়। লেখক তার লেখার পরতে পরতে এই আমোদের যোগান দিয়েছেন।
ঘটনা আরও এগুলে আমরা লাইলীর গুনাগুন সম্পর্কে আরও জানতে পারি। লাইলী চমৎকার গান গায়। তবে হিন্দু ইহুদী নাছারাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত না। একেবারে সহিহ উর্দু গজল। “নেগাহুকী সাদমে বেখুদ বানাদে, মুঝে সোফিয়া জামে ওহদাৎ পিলাদে” গেয়ে সে সবাইকে পাগল করে দেয়। পাঠক হিসেবে গজলের মানে পুরো না বুঝলেও ধারণা করতে পারি এখানে সোফিয়ার দেয়া জাম খেয়ে স্বাদে পাগল হয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে এখানে। তার গান শুনে তাকে টিভি রেডিওতে গান গাওয়ার কথা বলা হলে লাইলী ঝাড়ি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়, ইসলামে গান বাজনা হারাম। মনে পরে যায় আমার এক সহিহ শিক্ষকের কাহিনী। যিনি গান শুনে একটি মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। তারপর ফতোয়া দিয়েছিলেন, গান বাজনা হারাম, শুধু বেডরুমে চলতে পারে, এর বাইরে না। লাইলীও প্রায় একই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বেডরুমে গান গাওয়া সুবিচার, আর রেডিও টিভিতে গাওয়া ব্যভিচার।
সে যাই হোক, ফুটন্ত গোলাপের রিভিউ লিখতে থাকলে দেখা যাবে সেই বিষয়ে আলাদা একটা বইই লিখে ফেলেছি। গবেষণা করার মতো সেই পরিমাণে মণিমুক্তা এই বইতে আছে। তারচেয়ে বরং আমি এইখানেই ক্ষ্যামা দেই এই অনুরোধ করে, আজই বইখানা পড়ে দেখুন। রিভিউ শেষে একটি কথা বলেই শেষ করি। কাসেম বিন আবুবাকারের পাঠক কারা সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না। কেন এই দেশে তার বই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয় সেটাও বুঝতে সমস্যা হয়না। এই পাঠকেরাই বই পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখে, লাইলির মতো একটি ফুটন্ত গোলাপ তারা একদিন পাবে। এবং সেই গোলাপ একান্ত তারই হবে। একেবারে প্যাকেট করা অবস্থায়, আলো বাতাস মুক্ত অবস্থায় সেই গোলাপ তার সিন্দুকে থাকবে। সেই গোলাপের হাত পা মুখ কিছুই থাকবে না, শুধু গন্ধ থাকবে। এই পাঠকেরাই অফলাইনে গিয়ে ওড়না সরে যাওয়া কিশোরীটিকে দেখে লালা ফেলে, তারপর আবার গালি দেয় ওই মাগি তোর বুকে ওড়না কই। এই পাঠকেরাই অনলাইনে এসে সাকিব আল হাসানের সদ্য জন্মানো ফুটফুটে মেয়েটিকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেয়। এরাই মুশফিকুর রহিমের হাস্যোজ্জ্বল বাবা মায়ের ছবিতে অকল্পনীয় নোংরা গালি দেয় তার বৃদ্ধা মা বোরখা পরেনি বলে। এই পাঠকেরাই একই সাথে ধর্মগ্রন্থের বাণী আর চটি পছন্দ করে। এই পাঠকেরাই মেয়েদের সামলে চলার উপদেশ দেয়। আপনি যেমন হয়তো জানেন না কাসেম বিন আবুবাকার দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তেমনি হয়তো জানেন না তার লক্ষ লক্ষ পাঠকেরা এভাবেই ভাবে, এভাবেই চায়, এভাবেই ফুটন্ত গোলাপের স্বপ্ন দেখে, এভাবেই লোল ফেলে।
*পূর্বে সচলায়তন ব্লগে প্রকাশিত। লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত হলো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন