হাওয়া ছবিটা দেখতে গেলাম উন্মাদ পত্রিকার এক সহকারী সম্পাদককে নিয়ে। উদ্দেশ্য ‘উন্মাদে’ এই ছবির স্যাটায়ার করা হবে। কার্টুনিস্ট রাজীব অলরেডী ‘হাওয়া’ আঁকতে শুরু করেছে, সে ছবিটা দেখেছে। সংলাপ দেয়ার সুবিধার জন্য ছবিটা আমারও দেখা দরকার। সিনেপ্লেক্সে গিয়ে দেখি কোন সিট নেই। একদম সামনে নীচে একটা দুটা সিট নাকি আছে। আমি বললাম অসুবিধা কী, চলো দেখি। দু’জনে ঢুকে গেলাম, বিশাল স্ক্রিনের সামনে দু’জনের সিট। যেন থার্ড ক্লাসে সিনেমা দেখতে বসেছি দু’জন। আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার সহকারী মনে হল একটু উশখুশ করছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
আমার তখন একটা মজার স্মৃতি মনে পড়ল।
পাকিস্তান আমলে সম্ভবত ১৯৬৭-৬৮ সাল, আমি কুমিল্লা জিলা স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানের সব ছাত্রকে আইডি কার্ড দেয়া হবে এবং তারা সব জায়গায় ‘হাফ’ সুবিধা পাবে। ছাত্ররা মহা খুশি। একদিন আমরাও স্কুল থেকে আইডি কার্ড পেলাম। পরদিনই ছুটলাম কুমিল্লার লিবার্টি হলে সিনেমা দেখতে হাফ টিকিটে। পরদিন সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে লিবার্টি হল ইংরেজি ছবি দেখাত। তো আমি আমার এক বন্ধুকে নিয়ে হলে গিয়ে দেখি সব ছাত্রই আমার মতো হাফ টিকিটে সিনেমা দেখতে হাজির। টিকিটের লাইন বিরাট লম্বা। দেখি আমার আরেক বন্ধু কুল্টু তার ছোট ভাই লিটনকে নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো। তারা সামনের দিকেই দাঁড়ানো, খুব দ্রুতই মনে হয় টিকিট পেয়ে যাবে। এত লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে? আমি আর আমার বন্ধু কী করি ভাবছি। তখন দেখি এক লোক টিকিট বিক্রি করছে। (সে আসলে টিকিট ব্ল্যাকার, তখন এসব বোঝার কথা না।) তার কাছ থেকে দুটো টিকিট কিনে ফেললাম পানির দরে। মনে হল হাফ দামেই পেলাম। দুজনেই মহা খুশি, লাইনে না দাঁড়িয়েই হাফ দাম টিকিট পাওয়া সোজা ব্যাপার না। হলে ঢুকে তো আরও খুশি। আমাদের সীটের সামনেই বিশাল স্ক্রিন। এতো সুবিধা। আইয়ুব খানের প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। আসলে ব্ল্যাকার বেটা আমাদের থার্ড ক্লাসের টিকিট গছিয়ে দিয়েছিল। আমরা দুই বেকুব বুঝিনি। তাতে অবশ্য আমাদের খুশি এক বিন্দু নষ্ট হয় নি। সীটের সামনেই এত বিশাল স্ক্রিনে ছবি দেখার সুযোগ কয়জন পায়। পিছনে তাকিয়ে দেখি দোতালায় (মানে ডিসি ক্লাস) কুল্টু আর লিটনকে দেখা যাচ্ছে। তাদের দেখে আমরা আরো উত্তেজিত হলাম। হাত নেড়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। তারা অবশ্য সাড়া দিল না, গম্ভীর মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। ( ডিসি ক্লাসে বসে কেউ থার্ড ক্লাসের দর্শককে চেনে নাকি!) তবে আমরা দু’জন কিন্তু যথেষ্ট আনন্দের সঙ্গে সিনেমাটা উপভোগ করলাম বলাই বাহুল্য। আইয়ূব খানের সঙ্গে ঐ টিকিট ব্ল্যাকারের প্রতিও কৃতজ্ঞ বোধ করলাম যেন।
স্মৃতি এটুকুই। বহু বছর পর প্রায় এইরকম পরিস্থিতিতে হাওয়া ছবি দেখতে বসে কী মনে করে পিছনে তাকালাম যদি উপরের প্রিমিয়াম ক্লাশে কুল্টু আর লিটনকে দেখা যায়!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন