অন্যের চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখতে ভালোই লাগে। সেই মুগ্ধতা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন ভাল লাগাও অসীম হয়ে যায়।
অনেক অনেক দিন পর আমার জন্য কারো চোখে মুগ্ধতা ঝরতে দেখলাম। নাহ, কোনো রমণীর চোখে নয়, কোনো রোগীর চোখেও নয়। সেই মুগ্ধ চোখজোড়ার মালিক হচ্ছেন আমার বন্ধু কবির আহমদ। পেশায় চিকিৎসক। বর্তমানে কর্মরত আছেন সিলেট মেডিকেলে।
আমার এই বন্ধুর কম্পিউটার জ্ঞান শূণ্যেরও নিচে।
'মাইক্রোসফট ওয়ার্ড' বলতে তিনি বুঝেন, হাসপাতালের একটা 'ওয়ার্ড' যেখানে 'মাইক্রো' সাইজের 'সফট' বিছানা পাতা থাকে।
'এক্সেল' বলতে তিনি বুঝেন 'XL' সাইজের টিশার্ট।
'পাওয়ার পয়েন্ট' বলতে এই অবিবাহিত, ভার্জিন বিসিএস ক্যাডার কী বুঝেন, তা সভ্য সমাজে বলা যাবে না।
যাই হোক, পেশাগত কারণে পাওয়ার পয়েন্টে উনার একটা প্রেজেন্টেশন করতে হবে। কিন্তু উনি তো এসবের কিছুই বুঝেন না। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে কবির আহমদ শেষমেষ আমার দ্বারস্থ হলেন।
খুব কঠিন কিচ্ছু না। জিনিস তিনি কাগজ কলমে লিখেই এনেছেন। আমার কাজ খুব সহজ - পাওয়ার পয়েন্ট ওপেন করে স্লাইডে সেই লেখাগুলো টাইপ করে ফেলা।
১০ মিনিটেই টাইপ শেষ হয়ে গেলো। কবির আহমদের চোখে তখন কৃতজ্ঞতা।
কী মনে করে যেন আমি প্রথম স্লাইডের প্রথম লাইনটা হালকা BOLD করে দিলাম। মুহূর্তেই কবির আহমদের চোখ চকচক করে উঠলো। বিস্ময় তিনি লুকাতে পারলেন না। বলেই ফেললেন, 'বন্ধু, তুমি এটা কীভাবে করলে?'
আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলাম, মুরগা পাওয়া গেছে।
আমি মুখে যথাসম্ভব ভাবগাম্ভীর্য এনে উত্তর দিলাম, 'এইগুলা কম্পিউটারের জটিল বিষয়। মনিটরের ভিতরে থাকা একটা সফটওয়ারকে ডানে নিয়ে মাউস দিয়ে হালকা বামে ঘুরিয়ে দিয়েছি। এতেই লেখা কালা হয়ে গেছে। একটু কষ্ট হয়েছে, কিন্তু তোমার জন্য এই কষ্টটুকু করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।'
আমার প্রতিভা দেখে কবির আহমদের চোয়াল ঝুলে পড়লো।
চেহারায় বেশ একটা অপরাধী ভাব এনে কবির আহমদ আমাকে বললেন, 'বন্ধু, ৪ নম্বর স্লাইডের লেখাগুলো একটু ব্যাঁকা করে দিতে পারবে?'
আমি মুখে একটু চিন্তিত ভাব এনে তারপর বললাম, 'বিষয়টা একটু কঠিন। তবে আমি করে দিবো।'
কবির আহমদকে দেখিয়ে দেখিয়ে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুলে টানা পাঁচ মিনিট ধরে অংবং কিছু হিসাব টাইপ করলাম।
যেমন
x+y=t
1/2+8+akabaka=Y
y+q=kabir_Ahmed
অংবং হিসাবের পর পাওয়ার পয়েন্টে ফিরে যেয়ে সেই স্লাইডটা ইটালিক (কবিরের ভাষায় ব্যাঁকা) করে দিলাম।
কবির আহমদের বিস্ময় এবার মুগ্ধতায় রুপ নিলো।
তাঁরই বন্ধু আলিম আল রাজি তাঁরই সামনে কীভাবে এরকম প্রতিভাবান হয়ে উঠলো এটা তাঁকে খুব ভাবাচ্ছে - এটা বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হলো না।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুর চেয়ে তিনি যে জীবন যুদ্ধে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন, এই বাস্তবতাটা তাঁর চেহারাকে কিছুটা বিষণ্ণও করে তুললো।
মুগ্ধতা গোপন না করেই তিনি আমাকে বললেন, 'বন্ধু, শেষ স্লাইডে একটা Table বানিয়ে দিতে পারবা? বেশি না, উপর-নিচ মিলায়ে ৪টা ঘর দিলেই হবে।'
আমি আবারও গম্ভীর হয়ে বললাম, 'চারটা ঘর আঁকা একটু জটিল হয়ে যায়। তিনটা পর্যন্ত হলে মাইক্রোসফট ইজিলি দিয়ে দেয়। তবে তুমি যখন বলছো... আমাকে একটু সময় দাও...'
আমি সামনে থাকা বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি গিললাম। এসির রিমোট চেপে রুমটা আরেকটু ঠাণ্ডা করে নিলাম। টেবিল বানানো তো আর চাট্টিখানি কথা না।
আমি আবারও ওয়ার্ড খুলে অংবং হিসাব করলাম। তারপর পাওয়ার পয়েন্টে গিয়ে টেবিল বানানোর কঠিন কাজটি করে ফেললাম।
কবির আহমদের শ্যামলা চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। চোখ চকচক করে উঠলো। ঐ চেহারায় এখন মুগ্ধতা নেই, সেখানে এখন অনেক বেশি শ্রদ্ধা এবং একটুখানি কৌতুহল। আমি কীভাবে এসব করছি!
স্লাইড বানানো শেষ। তারপরেও আমি কবির আহমদকে দেখিয়ে দেখিয়ে কিছু যায়গা লাল, নীল, সবুজ রঙ করে দিলাম। ওদিকে মনিটরে ভেসে থাকা স্লাইডের রঙ পালটাচ্ছিলাম, আর এদিকে পাশে বসা কবির আহমদের মুখের রঙও বদলাচ্ছিলো।
বদলানোই স্বাভাবিক। তাঁরই প্রিয় বন্ধু হাতের ইশারায় রঙ দিয়ে এতসব রঙ-তামাশা করছে, এটা তো সহজ কোনো কথা না।
যাই হোক, উনার পেনড্রাইভে স্লাইড ট্রান্সফার করে বললাম, 'বন্ধু, সব মিলিয়ে খরচ পড়েছে পাঁচ হাজার টাকা। টেবিল বানায়া দিলাম, এইটার জন্য কম্পিউটারের স্কেল, কাঠপেন্সিল এবং কালি খরচ হয়েছে।'
ইউএসবি পোর্টটা দেখিয়ে বললাম, 'আর রঙও লাগলো অনেক। বাজার থেকে রঙ কিনে এনে এই পোর্ট দিয়ে আজই কম্পিউটারের ভিতরে রঙ ঢুকাতে হবে। তাছাড়া বিশ্বপরিস্থিতির কারণে রঙের দাম আবার একটু বাড়তির দিকে।'
কবির আহমদ তৎক্ষণাৎ আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুজে দিলেন। আমি 'নিবো না... নিবো না...' বলেও শেষমেষ নিয়ে নিলাম।
কবির আহমদের চোখের বিস্ময়, মুগ্ধতা এবং শ্রদ্ধা তখনও কাটেনি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এই সময়ে, কোভিড পরবর্তি এই বাস্তবতায় তাঁর প্রতিভাবান বন্ধু মাত্র ৫ হাজার টাকায় এত জটিল এবং কঠিন সব কাজ করে দিয়েছে, এই বিষয়টা তাঁকে আরো দীর্ঘদিন ভাবাবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন