আমাদের প্রজন্মের একটা অংশের রবীন্দ্রনাথভীতির পেছনে দায়ী জিনিসটার নাম হচ্ছে 'বিটিভি'।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আটটার সংবাদের আধঘণ্টা আগে বিটিভির পর্দায় একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতো। 'রে... রু... পে... পু... গে... গু...' অদ্ভুত বাজনা বাজতো আর পর্দায় লেখা আসতো 'রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান - গীতবিতান'।
অনুষ্ঠান শুরু হলে দেখা যেতো সেই একই দৃশ্য, একই সেট। একটা সিড়ির মতো উঁচু জায়গা, পেছনে রবীন্দ্রনাথের ইয়া বড় একটা ছবি, পাশে প্লাস্টিকের একটা গাছ। শিল্পীরা হেলেদুলে সেটে আসতেন, স্টেজে হাঁটা শুরু করতেন। নারী শিল্পীরা মাঝে মাঝে উঁচু জায়গাটায় বসতেন। আর সবাই নাভীর নিচে থেকে উচ্চারণ টেনে এনে গান গাইতেন।
আমাদের বেশিরভাগেরই ছিলো সাদাকালো টিভি আর দুর্বল অ্যান্টেনা। সাদাকালো টিভিতে ঝিরিঝিরি 'গীতবিতান' আমাদের কাছে আরো একঘেয়ে আর ভৌতিক হয়ে ধরা দিতো।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বা মৃত্যুদিন ছিলো আরেক বিভীষিকা! 'আলেখ্যানুষ্ঠান' নামক ভয়ংকর একটা জিনিস দেখা যেতো বিটিভিতে। সেটার টাইমিং-ও ছিলো অতি চমৎকার!
যেমন ধরুন, 'দ্যা নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব সিনবাদ' দেখার প্রস্তুতি নিয়ে টিভির সামনে বসে আছি। পুরো সপ্তাহের অপেক্ষা। তিমির পেট থেকে প্রিয় সিনবাদ কীভাবে মুক্তি পায় সেটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছি টিভির দিকে। ঘড়িতে ৮ টা বেজে ৩৫। পর্দায় অনুষ্ঠান ঘোষিকা আসলেন, এসে হাসিমুখে ঘোষণা দিলেন, 'এখন দেখবেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ আলেখ্যানুষ্ঠান ‘প্রাণে খুশির তুফান’।' ঘোষণা শুনে আমাদের প্রাণে তখন বেদনার তুফান!
আমরা আশা করে থাকতাম, 'আলেখ্যানুষ্ঠান' নামক জিনিসটার পরেই হয়তো সিনবাদকে দেখা যাবে। না, দেখা যেতো না। উলটা শুরু হতো আরেক যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনার নাম 'রবীন্দ্রনাথের নাটক'। আবারও বিটিভির সেই চিরচেনা সেট, চিরচেনা বাজনা, চিরচেনা ঝিরিঝিরি...।
স্মৃতি বলে, সেই রাতে আমরা অনুষ্ঠান ঘোষিকার ১৪ গোষ্ঠী আর রবীন্দ্রনাথ নামক বুড়ার ২৮ গোষ্ঠীকে গালাগালি করতে করতে ঘুমাতে যেতাম। আমাদের শৈশবের সন্ধ্যায় সিনবাদকে হটিয়ে যে রবীন্দ্রনাথ হানা দিতেন, সে রবীন্দ্রনাথকে আমরা ভয় পেতাম, অপছন্দ করতাম।
আমাদের প্রজন্মের ২১.৬ ভাগ ছেলেমেয়ে পরবর্তী জীবনে সেই ভয় আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং রবীন্দ্রনাথের আশেপাশেও ঘেঁষেনি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন