খুব রিসেন্টলি একটা জিনিস খেয়াল করলাম।
৩০/৪০/৫০ বছর আগের মুভি দেখতে বসলে কেমন জানি অস্বস্তি লাগে।
সাদাকালো জামানার ইংরেজী ভাষার যেকোন সিনেমা দেখতে বসলেই অস্বস্তিটা হয়।
ছবিগুলার ডায়লগ শুনতে কেমন জানি কানে বাজে।
মাত্র ৫০ বছরেই ইংরেজী ভাষায় পরিবর্তনটা আমার কানেই বেশ ধাক্কা খায়।
ভাষা নিয়ে অনেকের এলার্জি আছে। ছুত ছুত আছে।
এইভাবে বলা ঠিক না, ওভাবে কেন বলে না, এমন অনেক দাবীকে অনেকে বেশ জোর গলায় তুলে ধরেন। এই ধারণাটাকে আমার একদমই ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনে হয়। ভাষা আসলে আমার কাছে মনে হয় খুব ধীর গতিতে গড়ায়ে নামা হিমবাহ-এর মত। এর সরে যাওয়া, গড়ানো টেরই পাওয়া যায় না। কিন্তু আসলে ভাষা সরে, নড়ে। একটা বড় সময়ের আগপিছ করে দেখলে ভাষার এই প্রতিসরণ কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। আমার ইংরেজী জ্ঞান ভাল না। তাই বাংলায় উদাহরণ টানি।
বাংলায় গত ৫০ বছরে (আমার আন্দাজ, কম বেশি ও হইতে পারে। আমি তো আর তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখতেছি না যে প্রপার রেফারেন্স পাবেন। ধরে নেন আরকি ) কিছু শব্দ সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে যাচ্ছে, সামনে দিকে কুড়াল হয়ে বের হবে।
একটা শব্দ নেই, যেমন:
‘মারা’
শাব্দিক অর্থ অতি সরল: মেরে ফেলা, হত্যা করা ইত্যাদি।
শুরুতে এই শব্দ তার নিজের শাব্দিক অর্থের গণ্ডি পার হয়ে অন্য শব্দের সাথে ভিন্ন অর্থ নিয়ে যোগ করা শুরু হলো। শুরুতে ছোট্ট ছিল তাই কেউ অতটা পাত্তা দেয় নাই। কিন্তু এখন সে আরো স্পেস নিয়ে ফেলতেছে।
ফাঁকি মারা, ঝাঁকি মারা, ঝিম মারা, তালি মারা, ঢিল মারা, ধাক্কা মারা, চড় মারা
এই যুগে যখন ‘মারা’ শব্দ টা যোগ করা শুরু হল তখন একটা অদৃশ্য শর্ত ছিল। তা হলো: মারা'র সাথের শব্দটা মোটামুটি প্রাথমিক অর্থবহ একটা শব্দ হতে হবে। জানিনা এই ‘মারা’ যোগ করা শব্দযুগলকে প্রাথমিক পর্যায়ে কতটা চাপ সহ্য করতে হইছে। সুশীল সমাজ একে অশ্রাব্য, বর্বর বলে সীল মেরে দিসিলো কিনা। কিন্তু শব্দগুলা একটা বড় সময় পর্যন্ত টিকে তো গেছে। তারমানে এই শব্দযুগলের ব্যাবহারিতা আর গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট আছে।
তারপর যখন দেখা গেল 'মারা' একটা হার্মলেস শব্দ। তখন তাকে আরেকটু নড়াচড়া করার লাইসেন্স দেয়া হইল। নতুন নতুন শব্দের সাথে ‘মারা’ যোগ করার প্রবনতা আসলো। নতুন পর্বে ‘মারা'র’ সাথে প্রাথমিক অর্থ থেকে ভিন্ন এমন শব্দ দিয়ে নতুন অর্থবহ শব্দযুগল বানানো শুরু হল:
গুল মারা, চাপা মারা, টাংকি মারা, চোখ মারা, পাট মারা (অবশ্য ‘ইয়ে মারা’ ‘হাত মারা’ এই পর্বে পড়ছে, নোংরা অর্থবহন করার অপরাধে)
এই পর্বে খেয়াল করলে দেখা যাবে ‘মারা’ যদিও অনেক বোল্ড হইছে কিন্তু এখনও তার সাথে গেটিস শব্দ লেগে আছে। যদিও সেই শব্দের ‘মারা’ নামের ল্যাঞ্জা ছাড়া নিজের মূল অর্থ অনেক ভিন্ন। তাকে ‘মারা’ নির্ভর হয়ে চলতে হয় নতুন এই ভাব প্রকাশ করার জন্য। এই শব্দযুগলকে এখনো সার্বিকভাবে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হয় নাই। যদিও কথ্যরূপের মধ্যেই বেশি চলে। কিন্তু ইদানিং লিখিত সাহিত্য বা নাটক সিনেমা চিত্রায়নে চরিত্রের প্রয়োজনে এই শব্দব্যাবহারের নির্ভরতা বাড়তেছে। আমার ধারণা বলে, ‘মারা’ এই রাউন্ডের শব্দক্ষমতা নিয়ে টিকে যাবে।
এইবার আসি এলার্মিং স্টেজে। ‘মারা’ মোটামুটি বাংগালীর এত বেশি দরকারী শব্দ হয়ে গেসে, যে বাংগালীর এখন ‘মারা’ কে ওপেন লাইসেন্স দেয়ার অভ্যাস হয়ে গেসে। যদিও এই আধুনিক ফর্ম অনেক সেন্সেটিভ। ‘মারা’ এখন বিশেষ ক্ষেত্রে নিজেই একটা মৌলিক অর্থবহন করার চেষ্টা করে। রীতিমত তেজষ্ক্রীয় ক্ষমতা পাওয়া ‘মারা’ এখনো সাহিত্যে জায়গা করে নাই। তবে মুখে ব্যাবহার বেশ চালু হয়ে গেছে।
উদাহরণ দেই
ছাত্র: প্রশ্ন কঠিন হইছে। কঠিন ‘মারা’ খাইছি।
কর্মচারী: ভাবছিলাম ছুটি নিবো, বস ‘মারা’ দিয়ে দিছে।
নিষ্পেষিত জনতা: খালি আমাগোরেই পান, ‘মারা’ দেয়ার লাইগা ?
পুলিশ: এমন ‘মারা’ দিমু, কাউরে কইতারবি না।
মারা খাবা, মারা দিবো, মারা খাইছি, মারা দিছে
এমন শব্দের ব্যাবহার চোখ কান এড়ায়ে পার করতেছি আমরা, স্বীকৃতি দিতেছি না। কিন্তু, আমার মনে হয় এরাও একসময় হয়ত টিকে যাবে। যতই এদেরকে ধমক-ধামক বকা-ঝকা দিয়ে চেপে চুপে রাখা হোক না কেন। পাবলিক ইন্টারেস্টের জোরে ডেমোক্রেটিক ফর্মে ‘মারা’ এমন পাওয়ারফুল এখন যে, মারার সাথে বেসিক ভার্ব জোড়া দিয়েই কথা বলা যায়।
এবার আসেন সামনে কী হবে, ভাবি। এইক্ষেত্রে আমরা বাংগালী, চিরায়ত নিয়মে বিদেশী জিনিসের অনুকরণে হাঁটবো সেটা তো আর নতুন করে বলার কিছু নাই। তাই ধারণা করা যায় এক সময়ের ইংরেজীর দুষ্ট শব্দ ‘ফাক’ যেমন মোটাতাজা হয়ে এখন নিজেই বাক্যের ৭০% দখল করে নিয়ে
‘হেই ফাকার, হোয়াট দা ফাক ইউ ডুয়িং ফর ফাইভ ফাকিং মিনিটস’
‘আইল ফাক দা ফাকিং ফাকার টিল হি ফাকিং ডাই’
এমন পর্যায়ে ইংরেজী কথ্যভাষায় ঢুকে গেছে, মুখে মুখে ঝুলতেছে। তেমন করে কোনো একদিন হয়ত আমাদের বাংলা ‘মারা’ ও জোর বাড়ায়ে বাক্য দখলে নিয়ে নিবে।
মারানির পুতেরে, এমন মারা দিমু, মারা খাইয়া, আর কোনোদিন মারাইতে আইবো না। (উদাহরণ)
‘মারা’কে আর মারা যাবে না। ভাষার স্লো-মোশানের ঘোড়ার কাঁধে ‘মারা’ মতন এমন অনেক কিছু উঠে পড়ে যাদের আর নামানো যায় না। ভাষা বদলায়, নতুন শব্দ আসে, পুরানা শব্দ, পুরানা অর্থ হারায়ে যায়।
ভবিষ্যতে কোনো একদিন সিএঞ্জির পিছনে লেখা: ‘আমি ছোট আমাকে মেরো না’ দেখে কারো কারো খুব খারাপ কিছু মনে হতে পারে। দোষ দেয়া যায় না। এটাই হয়। মারার তো অনেক অর্থ । কোন মারা বুঝানো হইসে, সেইটা কে ধরে বেঁধে দিবে? তাই মারা তখন বহুমাত্রিক এক বিশাল শব্দভাণ্ডার। এর মানে হতে পারে অনেক কিছু।
আমরাই নিজেরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতে ভাষার ‘মারা’ দিয়ে ফেলি।
... আপাতত ‘মারা’ র প্রাথমিক অর্থের বর্তমান ব্যাবহারের শেষ শব্দটা বইলা নেই।
... মাইরালা আমারে মাইরালা
এরপরে আর কোনোদিন হয়ত ‘মারা’ তার প্রাথমিক অর্থ নিয়ে নতুন রূপে আসবে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন