ছোট একটা বাচ্চাকে আরেক বাচ্চা প্রশ্ন করল, ‘তুমি ক’টা রোজা রেখেছ?’
: একটা
: ওহ তাহলে আমার থেকে বেশী। ব্যাপারটা ঐ মাছ ধরার মত আরকি (নাকি ইয়ার্কি!)। ‘ক’টা মাছ ধরেছেন ভাই?’ উত্তর হচ্ছে ‘পরেরটা ধরলে একটা হবে!’ বাচ্চারা রোজা নিয়ে এমন মজাই করে। যেমন এক বাচ্চা বলছে, ‘মা বলেছে এবার আমার রোজা হবে ষাটটা।’
: কীভাবে?
: বাহ, সন্ধ্যার আগেই দুপুরে একবার ইফতার করবো যে?
তবে এসবই কৌতুকের বাচ্চা-কাচ্চাদের কাণ্ড! সত্যি বাচ্চারা কী করে? আমাদের ছোটবেলার কথাই ধরা যাক না। তখনও স্কুল ভর্তি হইনি। রোজা-রমজান মাস চলে এসেছে। রোজা রাখতেই হবে। যথারীতি সবার সঙ্গে ঘুম ঘুম চোখে ডিম, বেগুন ভাজি আর ঘি দিয়ে সেহরি খাওয়া হল। সকাল হয়েছে, নাস্তার টাইমে পেটের ভিতর ঘুটঘুটানি শুরু হয়েছে ...কিন্তু আমি তো রোজা। মা বললেন, ‘ঐ যে ঘরের কোনে পিতলের কলসি ঢাকনা দেয়া, ঢাকনা খুলে ওখানে রোজাটা রেখে নাস্তা খেতে আসো।‘
‘কিন্তু আমি তো রোজা।‘ মিন মিন করে বলি।
: সেই জন্যই তো বলছি রোজাটা ওখানে রেখে আসো। নাস্তা খেয়ে আবার কলসির ঢাকনা খুলে রোজাটা মুখে নিয়ে নেবে। ছোটদের রোজা রাখার এটাই নিয়ম।
বিপুল আনন্দ এবং বিস্ময় নিয়ে পিতলের কলসির মুখ খুলে হুপ করে রোজাটা কলসির ভিতর রেখে নাস্তা খাওয়া হল। তারপর পেট ভরে পানি খেয়ে ফের হুপ করে মুখে রোজাটা নিয়ে কলসির মুখ দ্রুত ঢাকনা চাপা দিয়ে ফেললাম। যেন কলসির মুখ খোলা পেলে রোজা আলাদিনের সেই জিনির মত বের হয়ে এসে সব গুবলেট করে দেবে! তারপর আর কি, কলসিবন্দি রোজা রেখে খেলতে চলে গেলাম মাঠে, রোজা ওদিকে ডাইলুট হতে থাকলো কলসির পানিতে! বেচারা রোজা। আহা, সত্যি কি সব মজার রোজা রাখার দিন ছিল সেইসব।
তবে আরেকটু বড় হলে বুঝলাম, কলসির ভিতর রোজা রাখা এ সবই আসলে দুষ্টু মায়েদের বুজরুকি। নাহ এবার (মানে পরেরবার আরকি, ইয়ার্কি না) সত্যি সত্যি রোজা রাখতেই হবে। পাশের বাসার কুল্টু আটটা রোজা রেখে ফেলেছে, পিছনের বাসার লিটন ছয়টা, আর দোতালার বাবলু চারটা... আর আমার কিনা এখনো একটা রোজাও রাখা হয়নি... ছি ছি । এ যেন এখনকার সিসি ক্যামেরায় ধরা পরে যাবার মত কোনো লজ্জার ব্যাপার।
তো সত্যি সত্যি একটা রোজা রেখে ফেললাম। আমার থেকে কিঞ্চিৎ বড়রা শ্রদ্ধার চোখে তাকাতে লাগলো নব্য রোজাদারের দিকে। বাবা প্রথম রোজা রাখার পুরষ্কার হিসেবে একটা চকচকে সিকি হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই সিকি মানে চারআনা নিয়ে মেঝো ভাইয়ের সঙ্গে চললাম ইফতার কিনতে। কত কিছু যে কিনলাম তার হিসাব নেই, মনেও নেই। তবে বুন্দিয়ার কথা এখনো মনে আছে। এখনকার বুন্দিয়া তো এক রঙের, তখনকার বুন্দিয়া ছিল নানান রঙের। এখনো দিব্যি মনে আছে সেই রঙিলা বুন্দিয়ার কথা।
তারপর ইফতার সামনে নিয়ে অপেক্ষা অপেক্ষা আর অপেক্ষা। ঘড়ির কাটা যেন কেউ শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। আমাদের টাইমে ইফতারের সময় মাইকে আজান হতো না। টিভি তো পাড়ার কারোরই ছিল না যে টিভিতে আজান শুনবো। কিন্তু সাইরেন বাজত। জলদ গম্ভীর সুরে সাইরেন। যেন গ্যাস টার্বাইনের বিশাল কোন জাহাজ গভীর সমুদ্রে হর্ন দিচ্ছে।
তবে এখন যেমন ইফতারের দোকান বসে, আগেও বসতো অবশ্য। এখনকার মত এত হাঁক-ডাক হৈ-চৈ ছিলো না। এখন তো ছোট চিকন জিলিপির জন্য এক লাইন, বড় জিলিপির জন্য আরেক লাইন, মামার হালিমের এক লাইন, এমনি হালিমের আরেক লাইন! সেদিন দেখি তরমুজ কেনার জন্যও লাইন! তরমুজ বিক্রেতা ওস্তাদ জাকির হোসেনের মত গম্ভীর হয়ে তরমুজের গায়ে তবলা বাজিয়ে এক এক করে বিক্রি করছে! কোনটা ৩০০, কোনটা ৪০০, কোনটা ৫০০...
আর এই রোজার সময়েই সবচে জরুরী যে লাইন; সেই সক্কাল থেকে টিসিবির তেল-নুন-চালের জন্য ঘামে ভেজা অনিশ্চিত দীর্ঘ ক্লান্ত লাইন... মনে করিয়ে দেয় বিষন্ন কোনো কবিতার অংশ বিশেষ।
‘ফের একদিন দেখা হবে আমাদের, অন্য কোনো লাইনে
হাতে হয়তো বাজারের ব্যাগের পরিবর্তে থাকবে একটা লাল ফেস্টুন
আর বাতাসে টায়ার পোড়ার গন্ধ...!’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন