পটকা ভাই বললেন, ‘বই বের করব।’
: কী বই?
: সমকালীন প্রেমের উপন্যাস—প্রেমিকার দিলে প্রেমের শস্যক্ষেত্র।
: প্রেম নাহয় বুঝলাম, কিন্তু শস্যক্ষেত্র কেন?
: সমকালীন প্রেমে কৃষিকাজের ভূমিকা নিয়ে উপন্যাস। এই উপন্যাসটি দেশের প্রেমের ক্ষেত্রে এবং কৃষিক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে!
আগেরবার তিনি কবিতার বই বের করেছিলেন—প্রিয়তমার দুটি হাত আমার হাতে নেই। সেই বই নিয়ে আবার মহাকেলেঙ্কারি। নিকটাত্মীয়, প্রেমিকা, বন্ধু এবং কাছের মানুষদের দেওয়ার পরও বেশ কিছু বই রয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পটকা ভাই তাঁর বইগুলো এলাকার লাইব্রেরিতে দিয়ে এলেন, যাতে পাঠকেরা পড়তে পারে। লাইব্রেরিয়ান দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরদিন সকালে এসেই সব বই ফেরত দিয়ে বলেছেন, ‘গরিব বলে যা তা জিনিস ধরায়া দিবেন...?’
পটকা ভাই জানালেন এবার তেমন কিছু হওয়ার আশঙ্কা নেই। মেলা শুরু হওয়ার আগ থেকেই তীব্র প্রচারণা শুরু করে দেবেন পুরো দেশব্যাপী। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে?’
: গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী—ঢাকা শহরের তিনটা বাস টার্মিনাল। এসব জায়গা থেকে বাস বিভিন্ন জেলায় যায়। আমরা খাঁচায়ভর্তি লিফলেট বাসের ছাদে বেঁধে দেব। কিন্তু খাঁচা বাঁধব আলগা করে। যাতে ধীরে ধীরে রশিটা খুলে যায়। বাস যাবে, রশি ঢিলা হবে, ধীরে ধীরে বাতাস খাঁচা থেকে লিফলেট বের করে রাস্তায় ফেলবে। বাস যত দূর যাবে, লিফলেট তত দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
: দারুণ আইডিয়া, ভাই! পুরো দেশ হাত-পা গুটিয়ে বসবে।
: কেন?
: বই পড়ার জন্য!
: অবশ্যই। এ ছাড়া ৫০ জন ছেলে, ৫০ জন মেয়ে পুরো মেলায় টি-শার্ট পরে ঘুরবে। টি-শার্টের এক পাশে প্রেমিকার দিলে প্রেমের শস্যক্ষেত্র বইয়ের ছাপ মারা থাকবে, অন্য পাশে থাকবে আমার ছবি।
: দারুণ হবে। আর কী কী থাকছে?
: পুরো মেলায় বিশাল বিশাল পোস্টার থাকবে। বিলবোর্ড করার পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু সরকার তো এখন বিলবোর্ড-বিরোধী। তারপরও কথা চলছে।
: দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারিং করলে ভালো হয় না? সঙ্গে সপ্তাহে দুই দিন মাইকিং।
: দারুণ! এ জন্যই তো তোকে আমার এত পছন্দ। তোকে দিয়েই হবে।
মহা উৎসাহে আমরা পটকা ভাইয়ের বইয়ের প্রচারণায় নেমেছি। এটা কোনোভাবেই নির্বাচনী প্রচারণা থেকে কম নয়। শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, পথেঘাটে লিফলেট। যেখানে লেখা ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বেস্টসেলার লেখক পটকা ভাইয়ের মাথা নষ্ট উপন্যাস প্রেমিকার বুকে প্রেমের শস্যক্ষেত্র এখন বাজারে!’
সকাল থেকেই এলাকায় এলাকায় মাইকিং শুরু হয়েছে। পটকা ভাইয়ের নির্দেশে বাছাইকৃত কিছু কিছু বাসার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘসময় মাইকিং করি। পটকা ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
: ওসব বাসা হয় আমার প্রেমিকার, নয়তো আমার প্রেমিকার শ্বশুরের। তাদের তো জানা দরকার, তারা কাকে হারাল!
মাইকিং চলছে, ‘এই মুহূর্তে দেশের সেরা লেখক, জনপ্রিয় কবি, রোমান্টিক উপন্যাসের পথিকৃৎ, বাংলা সাহিত্যের সাকিব আল হাসান পটকা ভাইয়ের রোমান্টিক উপন্যাস প্রেমিকার দিলে প্রেমের শস্যক্ষেত্র পাওয়া যাচ্ছে এই বইমেলায়...’
মেলা চলছে, পাশাপাশি ম্যালা টাকাও খরচ হচ্ছে। কিন্তু বই বিক্রির তেমন কোনো খবর নেই। পটকা ভাই বললেন, ‘আসলে কী জানিস, বাংলাদেশের মানুষের মনোজগৎ এখনো আমার বই পড়ার জন্য উপযুক্ত হয়নি। বড় ভুল সময়ে জন্ম নিয়েছি রে!’
কিন্তু মেলার ১৫ দিনেও নিকটাত্মীয় ও বন্ধুসমাজ ছাড়া কেউ বই না কেনায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দুই দিন তাঁর কোনো দেখা নেই। তৃতীয় দিনের মাথায় এসে বললেন, ‘প্রচারণার কৌশল পাল্টে ফেলেছি।’
: কেমন?
: আমরা ফ্রি ফ্রি বই বিতরণ করব।
: ফ্রি? কিন্তু কীভাবে?
: বৃদ্ধাশ্রমে বই পাঠিয়ে দেব। সেখানে তাঁদের সময় কাটতে চায় না। তাঁরা আমার বই পড়ে সময় কাটাবেন!
: তাঁদের শেষ কটা দিন শান্তিতে থাকতে দেবেন না, পটকা ভাই?
আমার প্রশ্ন শুনে পটকা ভাই ভীষণ অভিমান করলেন। ঠিক করলেন, আর কখনোই লেখালেখি করবেন না। সব প্রচারণা স্থগিত করে দিলেন। এদিকে প্রচারণা বন্ধের কারণে টাকার অভাবে আমি ঘর থেকে বেরোতে পারছি না। বিকেলের দিকে ফোন করলাম, ‘হ্যালো পটকা ভাই, একটা বুদ্ধি পেয়েছি আপনার জন্য। কোটি কোটি বই বিক্রি হবে।’
: কী? কী?
: আপনার স্টলে তো মানুষ নাই বললেই চলে, তাই না?
: হ্যাঁ...
: পোলাপান বই পেলে খুশি হয় নাকি ইন্টারনেট?
: দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে ইন্টারনেট।
: তাহলে আপনার স্টলে ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ের ঘোষণা দিয়ে দেন। বই কিনলেই ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ড ফ্রি!
পটকা ভাই দারুণ খুশি হলেন। খুশির ফলস্বরূপ সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে শহরের দামি রেস্তোরাঁয় পেটপুরে খাওয়ালেন। আমাকে দিয়ে যে কিছু একটা হবে, এ ব্যাপারে তাঁর মনে আর কোনো সন্দেহই নেই। স্বয়ং হিটলার এলেও আমার কিছু একটা হওয়া ঠেকাতে পারবেন না।
সারা রাত নতুন পোস্টার, লিফলেট ছাপানো হলো। পরদিন সেসব পোস্টার আর লিফলেট ছড়িয়ে গেল পুরো ঢাকা শহরে। প্রেমিকার বুকে প্রেমের শস্যক্ষেত্র বইটি কিনলেই ফ্রি ওয়াই-ফাই, একবার বই কিনে পুরো মেলায় ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনতে লাগল। পটকা ভাই অটোগ্রাফে ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ড দিতে দিতে গোটা তিনেক কলম ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছেন। লেখকেরাও পটকা ভাইয়ের বই কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁদের বই আছে, পাঠকও আছে, কিন্তু পাঠককে নিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেওয়ার মতো ইন্টারনেট নেই। স্টলের সামনে একজনকে দেখা যায় প্রতিদিন ফোনে কথা বলতে। একদিন কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রতিদিন এখানে এসে কথা বলেন কেন?’ উত্তরে বললেন, ‘আমার বাসার ইন্টারনেট খুব স্লো। বিদেশে কথা বলতে পারি না তো...তাই...!’
এই ঘটনার পর মেলায় আগত প্রত্যেক মানুষ পটকা ভাইকে চিনে ফেলেছে। সেবার তিনি বেস্টসেলার রাইটারও হয়ে গেলেন। এরপর থেকে তিনি যা-ই লেখেন, তা-ই বেস্টসেলার। অন্য লেখকেরা বেস্টসেলার হন বই প্রকাশের পর, পটকা ভাই লেখার আগেই ঠিক করে নেন বেস্টসেলার বই লিখবেন নাকি নরমাল কিছু! যাহোক মার্চের শেষ দিকে পটকা ভাইয়ের নামে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে একটা চিঠি এল। চিঠি পড়ে জানা গেল, মানুষকে ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিয়ে ডিজিটাল দেশ গড়ার কাজে সরকারকে সাহায্য করার জন্য পটকা ভাই এ বছরের সেরা প্রযুক্তিবিদ নির্বাচিত হয়েছেন!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন