মডেল হাইস্কুলের ক্লাস নাইনের প্রথম বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হবে শনিবারে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে প্রথম ব্যাঙ কাটা হবে। বায়োলজি স্যার আবদুল মজিদ ক্লাসে এসে বললেন বিষয়টা। ব্যাঙ কীভাবে কাটতে হবে, কী করতে হবে স্যার এর আগের ক্লাসে বুঝিয়ে বলেছেন। এবার প্র্যাকটিক্যাল। সবাই ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত।
স্যার বলেছেন, যারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে তাদের জন্য এই ক্লাস অতীব গুরুত্বপূর্ণ...এই ক্লাসেই বোঝা যাবে, কে ডাক্তার হতে পারবে আর কে পারবে না। ভাবভঙ্গিতে আপাতত মনে হচ্ছে ক্লাসের সবারই ডাক্তার হওয়ার পরিকল্পনা...অবশ্য ব্যাঙ কাটার ওপর পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে।
একজন হাত তুলল, ‘স্যার একটা প্রশ্ন ছিল’
- বলো
- স্যার আমরা ব্যাঙ কোথায় পাব?
- তোমরা ধরে আনবে। ক্লাসে একটা হাহাকারের মতো শব্দ হলো। ‘কোয়ায়েট...কোয়ায়েট...!!’ স্যার একটা হুংকার দিলেন। আবার একজন হাত তুলল। স্যারের ক্লাসে নিয়ম আছে হুট করে প্রশ্ন করা যাবে না, আগে হাত তুলতে হবে। ছেলেদের দল একবার হাত তুললে পরেরবার মেয়েদের দল হাত তুলবে। আগেরবার হাত তুলেছিল মেয়েদের দলের সাদিয়া। এবার তুলল ছেলেদের দলের রবীন
- বলো,
- স্যার প্রথমেই ব্যাঙ না কেটে তেলাপোকা কাটলে কেমন হয়?
- স্ট্যান্ডআপ অন দা বেঞ্চ। স্যার হুংকার দিলেন ‘শুধু ফাঁকি মারার অজুহাত খোঁজো?’
- স্যার কটা ব্যাঙ কাটা হবে? আরেকজন জানতে চাইল।
- মেয়েরা একটা কাটবে ছেলেরা একটা কাটবে। মেয়েদের ব্যাঙ মেয়েরা ধরে আনবে, ছেলেদের ব্যাঙ ছেলেরা ধরে আনবে।
এবার জেফ্রিন হাত তুলল - স্যার ব্যাঙ ধরা তো খুব কঠিন কাজ। আর ব্যাঙ আমরা পাব কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে সাদি হাত তুলল - স্যার আমরা যদি মেয়েদেরটা ধরে দিই?
সাদি আবার নারী জাতির ওপর বিশেষ শ্রদ্ধাশীল। তাই তার এই প্রস্তাব।
স্যার সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্ট্যান্ডআপ অন দা বেঞ্চ করলেন। তারপর যা বললেন তা হচ্ছে, যার কাজ তাকে করতে হবে, যার ব্যাঙ তাকে ধরতে হবে। ছেলে-মেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই। মেয়েদেরও দুটো হাত ছেলেদেরও দুটো হাত। যার যার কাজ তার তারই করতে হবে। লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ।...
‘লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ’ বাক্যটি স্যারের মুদ্রাদোষ। মাঝেমধ্যেই এটা বলেন। জেফ্রিন ক্লাসের সবচেয়ে ফাজিল টাইপের মেয়ে। সে বলে বসল, ‘স্যার আমাদের ক্লাসের ছেলেদের তিনটা হাত’
- মানে? স্যার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
- স্যার, ডান হাত বাম হাত আর অজুহাত। আমাদের ছেলেরা শুধু অজুহাত খুঁজে। ক্লাসের মেয়েরা হেসে উঠল। স্যার ‘কোয়ায়েট...কোয়ায়েট...!!’ বলে আবার একটা হুংকার দিলেন। তারপর বললেন বিজ্ঞান কোনো ইয়ার্কি-তামাশার ব্যাপার না বিজ্ঞান হচ্ছে গবেষণা, অ্যাডভেঞ্চার আর জ্ঞানের ব্যাপার...‘লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ’...পুষ্পসজ্জিত বিছানায় বসে বিজ্ঞান হবে না...এ রকম আরও কিছুক্ষণ ভারী ভারী কথা বললেন মজিদ স্যার।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত মেয়েদের দল থেকে সাহসী দুজনকে বাছাই করা হলো সাদিয়া আর মিতু। তারা মেয়েদের ব্যাঙ ধরবে। আর ছেলেদের দলের দুজন সাদি আর মিন্টু। ছেলেদের দলে এই দুজন স্বেচ্ছায় ব্যাঙ ধরে দেওয়ার জন্য ব্যাপক আগ্রহী। চাইলে মেয়েদেরটাও ধরে দেবে কিন্তু স্যারের কড়া নির্দেশ, যারটা সে ধরবে...লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ...! ক্লা
স শেষে গোপনে সাদি মিতু আর সাদিয়াকে বলল, ‘তোরা চাইলে তোদেরটা ধরে দিতে পারি, আমার বাসার কাছে ডোবায় ব্যাঙ ভর্তি।’ মিতু ও সাদিয়া তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল সাদির প্রস্তাব। তারা ব্যাঙ ধরার অ্যাডভেঞ্চারটা নিজেরাই করতে চায়। কারণ, ‘লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ’...যার কাজ তাকেই করতে হবে। বিজ্ঞান হচ্ছে গবেষণা, অ্যাডভেঞ্চার আর জ্ঞানের ব্যাপার...!
শুক্রবার সাদিয়া আর মিতু বেরোল ব্যাঙ ধরতে। কী ধরনের ব্যাঙ ধরতে হবে, তা অবশ্য স্যার বলে দিয়েছেন। কাজেই তারা রাবারের গ্লাভস ও মাছ ধরার হাতলওয়ালা নেট, হরলিকসের বয়াম। এসব নিয়ে বেরোল। বহু খোঁজাখুঁজির পর তারা একটা বেশ বড়সড় ব্যাঙের সন্ধান পেল। একটা বড় গাছের নিচে ঝোঁপের মধ্যে একটু পানি জমে আছে সম্ভবত বৃষ্টির পানি, সেই পানির মধ্যে আধা ডুবা হয়ে একটা ব্যাঙ বসে আছে। সাদিয়াই বেশি সাহসী, সে চট করে দুহাতে রাবারের গ্লাভস পরে ফেলল (গ্লাভস দুটো তার ডাক্তার বোনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে)।
- তুই নেটটা ধরে রেডি থাক। আমি ধরেই ঝুড়ির ভেতরে ফেলব...তারপর হরলিকসের বয়ামে।
- বেশ আমি রেডি। যেই না ধরতে যাবে ব্যাঙটাকে তখনই ব্যাঙটা এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল। কই যে গেল বুঝতেই পারল না দুজন। তখনই তারা টের পেল সত্যিই ‘লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ’...মানে ব্যাঙ ধরা সহজ কর্ম নয়।
আরও ঘণ্টা খানেক পর আরেকটা ব্যাঙের সন্ধান পেল। এটা আগেরটার চেয়ে বড়। এটাও একটুখানি পানির মধ্যে আধা ডুবো হয়ে বসে আছে। এবার অন্য সিস্টেম করল ওরা। আগে ঝুড়ি দিয়ে ব্যাঙটাকে আটকে ফেলতে হবে, পরে গ্লাভস পরা হাত দিয়ে ব্যাঙ ধরতে হবে। মিতু সাদিয়ার দিকে তাকাল।
- রেডি?
- রেডি
- ওয়ান টু থ্রি...ঝপ করে হাতলওয়ালা নেটটা দিয়ে ব্যাঙটাকে আটকে ফেলল মিতু। ‘আটকেছি ব্যাটাকে’ আর কী আশ্চর্য, নেটটা তুলতেই ব্যাঙ নেই...মুহূর্তে উধাও। এই করতে করতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। এর মধ্যে ওদের মায়েরা দুবার ফোন করেছেন।
- আমরা ব্যাঙ ধরছি
- কটা ধরলি?
- পরেরটা ধরলে একটা হবে।
- ফাজলামো না করে জলদি বাসায় আস। অনেক হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সত্যিই সত্যিই তারা একটা ব্যাঙ আটকে ফেলল। বয়ামে ঢোকাতে যাবে...কী আশ্চর্য, ব্যাঙটা মানুষের গলায় কথা বলে উঠল।
- অ্যাই তোমরা আমাকে ধরছ কেন?
- মা-মানে?? দুজনের গলায় কথা আটকে যায়। মিতু এক লাফে হাতলওয়ালা নেটটা ফেলে পিছিয়ে আসে। সাদিয়াও। দুজনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। ব্যাঙটা অবিকল মানুষের মতো কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘আমি আসলে ব্যাঙ না!’
- মা-মানে?? কোনোমতে তোতলাতে তোলাতে বলে সাদিয়া
- মানে তোমরা যা ভেবেছ আমি তা না। আমি ব্যাঙ না...
- তাহলে তুমি কী?
- তুমি করে বলবে না। বয়সে আমি তোমাদের অনেক বড়
- ঠিক আছে আ-আপনি তাহলে কী?
- আমি রাজপুত্র। এক ডাইনির অভিশাপে ব্যাঙ হয়ে আছি... পাঁচ হাজার বছর ধরে।
- বলেন কী?
- হ্যাঁ তাই। কোনো মেয়ে যদি ভালোবেসে আমাকে...
- বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না। রূপকথায় পড়েছি। তাহলে আপনি ফের রাজপুত্র হয়ে উঠবেন, তাই তো?
- হ্যাঁ তাই।
- কিন্তু সেটা সম্ভব না। শক্ত গলায় বলে মিতু।
- কী সম্ভব না?
- আমাদের একটা ব্যাঙ ধরতেই হবে। সকাল থেকে চেষ্টা করে আপনাকে পেয়েছি। আপনাকে ধরতেই হবে এবং নিয়ে যেতে হবে বায়োলজি ক্লাসে মজিদ স্যারের কাছে। স্যারের কড়া নির্দেশ।
- তারপর আপনাকে কাটাছেঁড়া করা হবে। সাদিয়া বলে।
- আমাকে কাটাছেঁড়া করে হবে কেন?
- বাহ্, আমরা ভবিষ্যতে ডাক্তার হব না? ব্যাঙ কাটা দিয়েই তো শুরু...
রাজপুত্র ব্যাঙ দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ করল। কিছু বলল না। নিজেই ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে হরলিকসের বয়ামে ঢুকে পড়ল।
শনিবারের বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ছেলেদের দল আর মেয়েদের দল ব্যাঙ নিয়ে হাজির। ছেলেদের ব্যাঙটা আচারের বয়ামে। আর মেয়েদেরটা হরলিকসের বয়ামে। স্যার ছেলেদের ব্যাঙের সাইজ দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। তারপর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘তোদেরটা দেখি?’
- ইয়ে স্যার...মিতু আর সাদিয়া একটু অস্বস্তিবোধ করে। হরলিকসের বয়ামটা পত্রিকার কাগজ দিয়ে মোড়ানো।
- কী হলো?
- স্যার...আমাদের ব্যাঙটায় একটু সমস্যা আছে
- কী সমস্যা?
- স্যার আমাদের ব্যাঙটা কথা বলা ব্যাঙ। বলে পত্রিকার মোড়কটা সরিয়ে ফেলে!
- কী??
- স্যার ব্যাঙটা মানুষের মতো কথা বলে
এবার স্যার গর্জন করে উঠল, ‘বিজ্ঞান কোনো ইয়ার্কি-তামাশার ব্যাপার না, বিজ্ঞান হচ্ছে গবেষণা, অ্যাডভেঞ্চার, জ্ঞানের ব্যাপার...‘লাইফ ইজ নট আ ব্যাড অব রোজ...’ স্যার কথা শেষ করতে পারলেন না। হরলিকসের বয়ামের ভেতর থেকে ব্যাঙটা সত্যি সত্যি কথা বলে উঠল।
- স্যার ওরা ঠিকই বলেছে, আমি আসলে ব্যাঙ না। আমি এক রাজপুত্র, ডাইনির অভিশাপে...
পুরো ক্লাসের সবার মুখ হা হয়ে গেল। ক্লাসের ভেতর যা দু-একটা মশা-মাছি ছিল তারা হঠাৎ নাই হয়ে গেল (কোথায় গেল তোমরা বুঝতেই পারছ)! তবে মজিদ স্যারের মুখটা হা হলো আরও বেশি। স্যারের সেই হা করা মুখ থেকে গো গো ধরনের একটা শব্দ বের হয়ে এল...তার পরই তিনি অজ্ঞান হয়ে আছড়ে পড়লেন প্রথমে টেবিলের ওপর, তারপর ক্লাসের মেঝেতে! তারপর আর কী, ক্লাসজুড়ে হইচই পড়ে গেল আর ওই ফাঁকে রাজপুত্র ব্যাঙ হরলিকসের বয়াম থেকে এক লাফে জানালায়, তারপর জানালা থেকে আরেক লাফে সোজা স্কুলের পাশের বড় ড্রেনটায়! তবে জানালায় বসে ব্যাঙটা একটা অমর বাণী দিয়ে গেল...!
বাণীটা অবশ্য স্কুলের সেই সময়কার হেড স্যারের ডায়েরিতে নোট করা আছে। হেড স্যার অবসরে যাওয়ার সময় তাঁর ডায়েরিটা স্কুলের লাইব্রেরিতে দান করে যান। বুঝতেই পারছ গল্পটা অনেক আগের। ১৫-২০ বছর তো হবেই। এই স্কুলে যারা নতুন ভর্তি হয়, তারা এই গল্পটা কীভাবে যেন জেনে যায়। তারপর লাইব্রেরিতে গিয়ে হেড স্যারের ডায়েরিটা খুঁজে বের করে ব্যাঙ রাজপুত্রের বাণীটা পড়ে। ডায়েরির ৪৮ পাতায় বাণীটা আছে। পরের পৃষ্ঠায় মানে ৪৯ পৃষ্ঠায় মিতু আর সাদিয়ার দুটো পাসপোর্ট সাইজ ছবি। নিচে লেখা, দুই কথা বলা ব্যাঙ আবিষ্কারক মিতু ইসলাম ও সাদিয়া রহমান। ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দ। তার নিচে হেড স্যারের স্বাক্ষর। রাজপুত্র ব্যাঙের বাণীটা এখানে প্রকাশ করা গেল না। তবে এই বাণী নিয়ে উচ্চপর্যায়ে গবেষণা চলছে। তবে শোনা যায়, এই বাণী গত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে নাকি ভাবসম্প্রসারণে এসেছিল।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন