অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল ১৯৩৯ সালে, এডলফ হিটলারকে শান্তিতে নোবেল দেয়ার জন্য মনোনীত করা হল! এটা একটা প্রাকটিক্যাল জোক বটে। যদিও ১৯৩৫ সালে ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনিকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করাটা কোনো কৌতুক ছিল না!
নোবেল জিনিসটা আস্তে আস্তে জ্বলজ্যান্ত স্যাটায়ার হয়ে গেল, একেকজন নোবেল বিজয়ী হয়ে গেলেন জনপ্রিয় কৌতুকের উৎস! এই রুই মাছের জন্মের কিছু কথা শোনা যাক।
বহু বছর আগের কথা, এক সুইডিশ আবিষ্কারক একটা ‘বোমা’ আবিষ্কার করলেন। নাম দিলেন ‘ডিনামাইট’, কামালেন বেশ টাকা-পয়সা।
একবার হলো কি, তার ভাই মারা গেল। পত্রিকাওয়ালারা ভুলে ভাবলো, আবিষ্কারক ভদ্রলোক মারা গেছেন। তাকে মৃত ভেবে তার মৃত্যুসংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হল, শিরোনাম- ‘মৃত্যুর সওদাগর মৃত্যুবরণ করেছে’! ভেতরের বর্ণনা- ‘আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেল, যিনি বড়লোক হয়েছেন আগের চেয়ে বেশি এবং দ্রুতগতিতে মানুষ মারার নিত্যনতুন পন্থা আবিষ্কারের মাধ্যমে’। পত্রিকায় ভুলক্রমে প্রকাশিত মৃত্যু সংবাদ পড়ে আবিষ্কারকের সাংঘাতিক মন খারাপ হলো। তার মানে, তিনি মারা গেলে মানুষ তাকে মৃত্যুর সওদাগর বলে চিনবে?
ডিনামাইটের জনক উঠে পড়ে লাগলেন মৃত্যু-পরবর্তী নিজের সম্ভাব্য ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে। উপার্জিত সব অর্থ সম্পদ উইল করে দিলেন নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত পুরস্কারের জন্য। তাড়াহুড়ার কারণে গণিত চিরতরে এবং অর্থনীতি বছর পঞ্চাশেকের জন্য বাদ পড়ল পুরস্কারের বিভাগ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দৌড় থেকে। ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এই বিভাগগুলোর তেমন দরকার আছে বলে মনে হয়নি তার।
সেই থেকে বাজারের বড় রুই মাছ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পুরস্কারটি ক্ষমতাবান বিভিন্ন বাড়িতে বিভিন্ন উপলক্ষে পাঠানো শুরু হল। মাঝে মধ্যে ‘রুই’ মাছ কেনাবেচাও চলতে লাগল, মাঝে মাঝে ভাগাভাগিও। বিভিন্নভাবে ভাগ হওয়া এই রুই মাছের মাথা-পেট-লেজ ভাগাভাগির ভেতরে আমাদের মতো পুঁটি এবং কাচকি মাছেদের তেমন কোনো ভূমিকা থাকার কথা না।
মাতবর, মোড়ল এদের দিকে চোখ বুলানো যাক-
এ পর্যন্ত আমেরিকার চারজন প্রেসিডেন্ট এবং একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট শান্তিতে রুই মাছের মাথার ভাগ পেয়েছেন। টিকে থাকতে হলে মোড়লদের তো খুশি রাখতেই হবে। মোট ২৭ জন* সরকারপ্রধানকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে রুই মাছ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের ভেতর আছেন যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, জার্মানি, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, কোরিয়ার মতো দেশের সরকারপ্রধানদের নাম।
যেমন- ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের রুই মাছ প্রাপ্তি সাহিত্যে। যেখানে মার্ক টোয়েন, জেমস জয়েস, লিও তলস্তয়, আর্থার মিলারদের সাহিত্য প্রতিভার কাছে চার্চিলের ‘প্রতিভা’কে নস্যি বলা চলে! তাদের কপালে রুই মাছ দূরে থাক, মাঝারি সাইজের তেলাপিয়াও জোটেনি।
আবার বারাক ওবামার রুই মাছ প্রাপ্তি শান্তি প্রতিষ্ঠায়। পৃথিবীতে প্রথম স্থানে থাকা অস্ত্র বিক্রেতা দেশের প্রেসিডেন্ট, ‘শান্তি’ রক্ষার জন্য পুরস্কার তিনি না পেলে আর কে পাবেন! আর বিভিন্ন দেশে সৈন্য পাঠিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটু-আধটু অভ্যাস তো আছেই।
অথচ ডিনামাইটের আবিষ্কারক ভদ্রলোক ওছিয়তনামায় বলে গিয়েছেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভেতর ভ্রাতৃত্ব তৈরি এবং পদাতিক সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি কিংবা হ্রাসকরণে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তাকে শান্তি স্থাপনে রুই মাছ পুরস্কার দেয়া হবে’।
মাতবর মোড়লদের শান্তিতে নোবেল পাওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা এরকম-
-এই বছর ‘কইতরছিলা বাবুল’ নোবেল পাইছে
-কি করে ‘কইতর বাবুল’?
-অস্ত্র বেঁচে। মাঝে মধ্যে তার লোকজন এলাকায় গোলাগুলি করে, শান্তি প্রতিষ্ঠায়।
-বাহ! অবশেষে যোগ্য লোক নোবেল পাইছে।
১৯৭৩ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার শান্তিতে রুই মাছ পেয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান যখন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছিল, আমেরিকার তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার তখন যা বলেছিলেন তার অর্থ অনেকটা এই রকম, এইগুলা বাচ্চাদের দুষ্টুমি। বাচ্চাদের দুষ্টুমির ভেতর আমাদের বড়দের যাওয়ার কী দরকার, করুক দুষ্টুমি। তাকে অভিযুক্ত করে এখন পর্যন্তু দু-চারটা গণহত্যা বিষয়ক বইও লেখা হয়ে গেছে।
কার্ট হুটন নামক ভদ্রলোক ‘লোবোটমি’ নামের মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলার ‘সিস্টেম’ প্রচলনের জন্য চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পান। ফ্রিটজ হেবার নামক জার্মান কেমিস্ট বেচারাকে রুই মাছ দেয়া হয়েছিল রসায়নে। সেই হেবার পরবর্তীতে জার্মান সরকারকে বিষাক্ত গ্যাস বানানো শিখিয়েছিলেন। তাকে বিষাক্ত কেমিক্যাল গ্যাসের যুদ্ধকৌশলের জনক বলা হয়।
নোবেল প্রাপ্তি অনেকটা এরকম হয়ে গেল এক পর্যায়ে-
-শুনছোছ, কিলার শামসু নোবেল পাইছে।
-কেমনে কি! ও না সিরিয়াল কিলার?
-হ্যা! কিন্তু ওর ‘সিরিয়াল কিলিং’ এর গল্পগুলা সাহিত্য জগতে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতেছে।
-ওহ!
-এছাড়া বাচ্চা ঘুম পাড়াইতে মায়েরা বলে, ‘ঘুমাও, নাইলে কিলার শামসু আসবে’। বাচ্চা ঘুম পাড়ানির ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকার জন্য শান্তিতে এই নোবেল পুরস্কার।
এমন বাস্তব রম্যের সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেল কমিটিকেই একবার নোবেল প্রদান করার দাবি জানানো যেতে পারে।
মহাত্মা গান্ধী অহিংস আন্দোলন করে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন করলেও তাকে শান্তিতে বেল কিংবা নোবেল, কিছুই প্রদান করা হয়নি। অথচ গণহত্যা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মানুষদের নোবেল দেয়া হয়েছে। মোড়ল তাড়িয়ে নোবেল? নাহ, কখনোই না!
নোবেল জিনিসটা এরপর আস্তে আস্তে রুই মাছ থেকে চকলেট আইসক্রিমের মতো হয়ে যেতে থাকল। অনেকটা এরকম-
বাবুর মা: এই, শুনছো, বাবু কান্দে.....
বাবুর বাবা: আহহা, দোকান থেকে একটা নোবেল আইনা দিলা না কেন....
বাবুর মা: শান্তিতে নোবেল কিইন্যা দিছি তো, এইবার সাহিত্যে নোবেল চায়....
এ পর্যন্ত ৯০৪ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যার ভেতর সাড়ে তিনশর বেশি যুক্তরাষ্ট্রের, ১৩৩ জন যুক্তরাজ্যের।* বাকি বেশিরভাগ ব্যক্তিই ইউরোপকেন্দ্রিক। গণিতের জন্য আজও কোনো বিভাগ করা হয়নি। জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রশ্নবিদ্ধ সংস্থাকে নোবেল দেয়া হয়েছে। পরাশক্তিদের বশীকরণ এবং দুর্বল রাষ্ট্র খুশিকরণের উপায় হিসেবে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে এই পুরস্কার। তারপরও, দামি এই রুই মাছের ভাগের ব্যাপারে আমরা আজও উন্মুখ বসে থাকি।
একটি নোবেল বিষয়ক কৌতুক দিয়ে শেষ করা যাক।
বারাক ওবামা শান্তিতে কেন নোবেল পেয়েছিল?
-কারণ তার ওড়ানো ড্রোনগুলো ছিল শান্তির দূত কবুতরের মতো সাদা রঙের!
[*অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন