একদিন দুপুরের ঘটনা। হোটেলে খেতে গিয়েছি, ওয়েটারকে ডাক দিয়ে বললাম, ভাত দ্যান। সাথে গরুর মাংস আর ডাল।
ওয়েটার: ভাত হইতে দেরি আছে ছার। খিচুড়ি খান।
খট করে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। খিচুড়ি খেতে হলে তো খিচুড়িই অর্ডার করতাম। ব্যাটাকে পাকনামি করে আবার খিচুড়ি সাজেস্ট করতে কে বলেছে? বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাত হতে কতক্ষণ লাগবে?
ওয়েটার: বিশ মিনিট।
বিশ মিনিট ভাতের জন্য বসে থাকা সম্ভব না। নিরুপায় হয়ে খিচুড়ি অর্ডার করলাম। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলো। আজকাল আর লাঞ্চে খিচুড়ি-মিচুড়ি খেতে শরীর টানে না। রেগুলার ভারি খাবার খাওয়ার বয়সটা মনে হয় চলে যাচ্ছে।
একটু পর ওয়েটার খিচুড়ি নিয়ে আসলো। ভাত না পেয়ে যে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সেটা সে মনে হয় খানিকটা আন্দাজ করেছে। প্লেটে লেবুর সংখ্যা দুই পিস বেশি।
শুকনা খিচুড়ি গলা দিয়ে নামছে না। মাথার মধ্যে এখনো ভাত আর ডাল। ভাবছি গরম গরম ডাল পেলে ভাত মাখিয়ে লোকমা নিলে সুরুত সুরুত করে চলে যেত পেটে।
আমার এই সমস্যাটা অনেকদিনের। মাথার মধ্যে একবার একটা কিছু ঢুকলে আর সহজে বের হতে চায় না।
তাই আর বৃথা চেষ্টা না করে ওয়েটারকে ডাক দিয়ে বললাম একটা ডাল দেন।
ওয়েটার: ছার, খিচুড়ির সঙ্গে ডাল?
: ক্যান, কোন সমস্যা!
: না ছার... খিচুড়ির লগে কেউ ডাইল খায়না তো তাই।
: আমি খাই। আর শোনেন, সাথে এক বাটি পালং শাক দিয়েন।
: ...আচ্ছা ছার!
একটু গাইগুই করে ওয়েটার চলে গেলো ডাল আর শাক আনতে।
কিছুক্ষণ পর ওয়েটার ডাল আর পালংশাক নিয়ে হাজির। তার সাথে আরও দুজন ওয়েটার কারণ ছাড়া হাজির। তিনজনেরই বেশ হাসি হাসি চেহারা।
মনে হয় ভাত না পেয়ে 'ছার' ডাল আর শাক দিয়া খিচুড়ি কিভাবে খায় সেটা দেখতেই আসা।
আমি তাদের কৌতুকপ্রদ চেহারায় পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর মুখে খিচুড়িতে ডাল মাখিয়ে সুরুত সুরুত করে খেতে শুরু করলাম। যেরকমটা ভেবেছিলাম সেরকমই হয়েছে। ডালের কারণে ভুনা খিচুড়ির কসা ভাবটা চলে গিয়ে গলা খিচুড়িতে রুপান্তর হয়েছে। পালং শাকটাও এর সাথে দারুণ লাগছে।
চেটে পুটে খাচ্ছি, এমন সময় টেবিলে আরেক ভদ্রলোক এসে হাজির। হাতে একটা ব্রিফকেস। মনে হয় আশপাশের কোনো অফিস থেকেই লাঞ্চ ব্রেকে বের হয়েছেন।
ওয়েটারকে ডাক দিয়ে বললেন: এই যে ভাই একটা ভাত দেন।
ওয়েটার: ভাত নাই, ১৫ মিনিট লাগবো।
ভদ্রলোক: দুপুর বেলা ভাত নাই? হোটেল দিসেন ক্যান? কিসের ব্যবসা করেন?
স্বাভাবিকভাবেই তার মেজাজটা যে খারাপ হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। ওয়েটার সেদিকে তোয়াক্কা না করে বলল, 'খিচুড়ি আছে, খিচুড়ি খান?'
ভদ্রলোক: (বিরক্ত হয়ে) দাও আর কী করবা? সাথে একটা গরুর মাংস দিও।
খিচুড়ি আর গরুর মাংস দিয়ে যাওয়ার পর ভদ্রলোকের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো।
: এ কি খিচুড়ি দিছো? গলা দিয়া নামে? আর এগুলা কি মাংস না হাড্ডি?
ওয়েটার কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল, ডাল দিয়া দি ছার? ডাল দিয়া খান?
সমাধানটা সে মাত্র আমার কাছ থেকে বের করেছে বোঝা যাচ্ছে।
ভদ্রলোক: ওই বেটা মশকরা করোস? ডাল দিয়া কেউ খিচুড়ি খায়? যা বেটা এই মাংস খামু না নিয়া যা এইখান থেকে।
ভদ্রলোকের সম্বোধন ততক্ষণে আপনি থেকে তুমি হয়ে তুইতে নেমে এসেছে।
ওয়েটার কাচুমাচু হয়ে গরুর মাংসের প্লেটটা ভদ্রলোকের সামনে থেকে নিয়ে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো।
ভদ্রলোক: (চিৎকার করে) খিচুড়ির লগে আর কী আছে?
আর কিছু না থাকায় ওয়েটারও চিৎকার করে বলল, 'পালংশাক ছার।'
বুঝতে পারলাম, আমার আসলে জনসম্মুখে খিচুড়ির সাথে ডাল আর শাক খাওয়াটা ঠিক হয়নি।
ভদ্রলোক: ওই ব্যাটা খিচুড়ি দিয়া পালংশাক খামু? কি পাইছোস তোরা আমারে?
ভদ্রলোক রাগে থরথর করে কাঁপছেন, সে সময় তার সামনে এক্সট্রা টুকরাসহ গরম গরম গরুর মাংস পরিবেশন করা হলো। এতে মনে হয় ভদ্রলোকের রাগ একটু কমলো। কিন্তু খিচুড়ি দিয়ে মাংসটা মাখিয়ে খেতে গিয়েই ভদ্রলোক বুঝলেন খিচুড়ির ঝাঁঝ।
ততক্ষণে আমি ডাল দিয়ে খিচুড়ি শেষ করে, লেবু দিয়ে প্লেট কাচাচ্ছি। ডাল এমন একটা জিনিস যেটা দেখেলে বেশিরভাগ বাঙ্গালিরই মাথার ঠিক থাকে না। অতঃপর ভদ্রলোক বারবার আমার ডালের বাটির দিকে তাকাচ্ছেন দেখে আমি বললাম,
'নেবেন নাকি একটু? ভালোই লাগে কিন্তু! আমার খাওয়া শেষ। আপনি চাইলে নিতে পারেন।'
ভদ্রলোক একটু লজ্জিত চেহারা করে তার খিচুড়িতে দুই চামচ ডাল নিলেন। লজ্জাটা কিসের ঠিক বুঝলাম না। খিচুড়ির সাথে ডাল খাওয়ার লজ্জা বোধহয়।
এমন সময় ভদ্রলোকের ফোন বাজলো। স্ত্রী ফোন করেছেন বোধহয়।
ফোন স্পিকারে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, 'ভাত খাচ্ছি, খেয়ে ফোন দিচ্ছি।'
ওয়েটার (হাসি হাসি মুখ করে): ভাত না তো ছার খিচুড়ি। বলেন খিচুড়ি খাইতেছেন।
ভদ্রলোক: (রেগে মেগে) ওই ব্যাটা তোরে কইতে হইবো আমি কী খাইতেছি। একে দেস নাই ভাত... ভদ্রলোক আরো কিছু বলতে যাবেন, ফোনের অপর পাশ থেকে তার স্ত্রী বললেন, 'ওহ হো! ওয়েটারদের সাথে খারাপ ব্যবহার কোরো না তো। কী দিয়ে খাচ্ছো খিচুড়ি?'
ভদ্রলোক আশেপাশে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, 'ডাল দিয়ে!'
স্ত্রী: কী! ডাল দিয়ে! ডাল দিয়ে খাচ্ছ কেন খিচুড়ি? কি হয়েছে তোমার?
এতক্ষণে চারদিকে আবার আগ্রহীর দল উপচে পড়েছে। ভদ্রলোক স্ত্রীর কাছে ডাল দিয়ে খিচুরি খাওয়ার পেছনে কী অযুহাত দেখান সেটা জানতেই বোধ হয় এত আগ্রহ।
পেছনের টেবিলে এক ভার্সিটি পড়ুয়া জুটি বসা, তাদের মধ্য থেকে মেয়েটি বলে বসলো, 'হি হি হি, বেবি দেখো খিচুড়ির সাথে ডাল নিচ্ছে। হি হি হি ডালের সঙ্গে খিচুড়ি।'
ভদ্রলোক কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তাকে খিচুড়ির সাথে ডাল খাওয়ানোর দায় এড়াতে আমিও ততক্ষণে উঠে পড়েছি। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে বের হয়ে যাচ্ছি, ঘড়িতে দেখলাম বিশ মিনিট শেষ হয়ে গেছে। ততক্ষণে খিচুড়ির বদলে ডেকচি ভরে চলে এসেছে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত...!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন