একজন অনলাইন বুদ্ধিজীবি রাশিয়া বিশ্বকাপকে যেভাবে বিশ্লেষণ করবেন

৭৮৭ পঠিত ... ১৩:৩২, জুলাই ১৫, ২০১৮

রাশিয়া পৃথিবীকে নতুনত্ব উপহার দিয়েছিল গত প্রায় ১০০ বছর আগে কমিউনিজমকে প্রাণ দিয়ে। এই কমিউনিজম রাশিয়া ছেড়ে পার্শ্ববর্তী অসংখ্য দেশে ছড়িয়ে পরে অনেকটা দাবানলের মতই। রাশিয়া, যাকে কি না ইউরোপে রাখতে নারাজ অনেকে, আবার এশিয়াতেও রাখতে নারাজ। প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটারে আয়তন নিয়ে রাশিয়া যেন নিজেই এক মহাদেশ। অবশেষে বিশ্বকাপ ফুটবলের একুশতম আসর বসল মহান রাশিয়ার মাটিতে। কেমন হয়েছে এই বিশ্বকাপ? বিশ্বজুড়ে এর রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক প্রভাবটাও বা কেমন। আমাদের জাতীয় পর্যায়েই বা কেমন প্রভাব ফেলেছে এবারের বিশ্বকাপ। সবটা জানতেই পড়ে নিন বিশ্বকাপের এই আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ককটেল বিশ্লেষণ।

বিশ্বকাপের প্রথম ১৬টি আসর ভাগাভাগি করে আটলান্টিকের এপার আর ওপারে বসেছে। এরপর ধীরে ধীরে এশিয়া, আফ্রিকা হয়ে অবশেষে বলশেভিক বিপ্লবের ১০০ বছর পর রাশিয়ার মাটিতে আসে বিশ্বকাপ। কমিউনিজম প্রাণ পেয়েছিল যে মাটিতে, সেই মাটিতে বিশ্বকাপটা আর দশটা বিশ্বকাপের মতো না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে প্রলেতারিয়েতদের বিশ্বকাপ। ফুটবল দুনিয়ায় যে সব দল নিগৃহীত-নিপীড়িত হয়েছে দীর্ঘদিন, তারাই যেন ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রবল শক্তিতে।

গ্রুপ এফ-এ পুঁজিবাদী জার্মানিকে রুখে দিয়েছে খেটে খাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলাররা। গ্রুপ ডি তে শ্রমিকদের প্রতিরোধে পড়েছিল আরেক পুঁজিবাদী শক্তি আর্জেন্টিনা। কিন্তু প্রভাবশালী মেসির ক্ষমতার দাপটে গ্রুপ পর্ব উৎরে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু এই গ্রুপেই এক নতুন শক্তির উথান হয়, যার নাম ক্রোয়েশিয়া। ফুটবলে এখনো মধ্যবিত্তের কাতারে থাকা এই দল আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারিয়ে যেন নতুন শতাব্দীর সূচনা করে। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই তারা থেমে থাকেনি। তারা চলে গেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে। যাত্রাপথে তারা ইংল্যান্ডের মতো বিত্তশালী দলকে উড়িয়ে দেয়।

অবশ্য নব্য পুঁজিবাদীদের কেউ কেউ এবার শক্তি প্রদর্শন করেছে বেশ ভালোভাবেই। টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট বেলজিয়াম যেমন একের পর এক দলকে উড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছে। তারা পরাক্রমশালী ব্রাজিলকেও বিদায় করে দেয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই বেলজিয়ামের ভেতর সব রকমের পুঁজিবাদী চরিত্র দেখা যাচ্ছে বলে অনেক ফুটবলবিজ্ঞানী মত দেন।

এবারের বিশ্বকাপে আমেরিকার অংশ না নিতে পারাটা রাশিয়া আর আমেরিকার দীর্ঘদিনের বৈরিতার আরও একটি নিদর্শন। আবার নিজ দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করে রাশিয়া আরেকটু হলে সেমি ফাইনালেই চলে যেত। যাকে কি না, অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন ক্ষমতার অপব্যবহার। অনেকেই ধারণা করছেন, স্বাগতিক হয়েই রাশিয়া পুতিনের সাহায্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্বকাপে এতটা সাফল্য পেয়েছে। অবশ্য রাশিয়া সৌদি আরব ও মিশরকে রীতিমত উড়িয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব আরও খানিকটা বিস্তৃত করেছে। এটি আমেরিকার জন্য এক রকমের প্রচ্ছন্ন হুমকি হয়ে থাকবে বলেই ধারণা করছেন সবাই।

এবারের বিশ্বকাপ খুব বেশি দূর খেলতে দেয়নি, মেসি রোনালদোর মতো বিত্তশালী ফুটবলারদের। দ্বিতীয় রাউন্ডেই গত দশ বছরের বিশ্বসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেয়া এই দুই খেলোয়াড়ের বিদায় একটি সাম্যতার বিশ্বকাপকেই নির্দেশ করে।

অন্যদিকে ‘হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ’ প্রবাদটি আরও একবার সত্য প্রমাণিত হল। ৭ দশক আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি শত চেষ্টা করেও দখল করতে পারেনি মস্কো। শীতকালীন রাশিয়া জার্মানিকে ধ্বসিয়ে দেয় ভয়াবহভাবে। এই এতদিন পরে এসে জার্মান ফুটবল দল আরও একবার রাশিয়া থেকে খালি হাতে বিদায় নিল। ব্যর্থ হয়েছিল হিটলার, ব্যর্থ হতে হল মুলার-ওজিলদেরও।

আমাদের দেশেও বরাবরের মতো এবারেও বিশ্বকাপ একইসাথে স্থিতিশীলতা এবং অস্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছে। স্থিতিশীলতা এসেছে সকল প্রকার জাতীয় সংকটের কথা ভুলে যেয়ে। ফুটবল বিশ্বকাপকে একদল সমাজবিজ্ঞানী আফিমের সাথে হরহামেশাই তুলনা করে থাকেন। বিশ্বকাপের নেশায় বুদ হয়ে সবাই যেভাবে অন্য সব সমস্যার কথা ভুলে যায়, সেটা সমাজে এক রকমের স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। আবার সুদূর লাতিন আমেরিকার দুই দেশ ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থন কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। তর্ক, আক্রমণ, পালটা আক্রমণ, ব্যক্তি আক্রমণ থেকে শুরু করে রসিকতা, হাসি ঠাট্টা সবটাতেই যেন উত্তাপ।

 

তবে এ বছর ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সাথে সঙ্গী হয়েছিল পর্যাপ্ত পরিমাণ জার্মানির সমর্থক। একই সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেলজিয়াম সমর্থককেও দেখা গেছে। তবে প্লাস্টিক, পতাকা উল্টানো সাপোর্টার ইত্যাদি নানা রকম অপমানসূচক তকমা পেতে হয়েছে তাদের। বাংলাদেশি ফুটবল সমর্থকদের জন্য বিশ্বকাপ খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গ্রুপ পর্বে জার্মানি বাদ পড়ে একদল সমর্থককে প্রায় এতিম করে রেখে যায়। এমনকি তারা পতাকা উল্টিয়ে বেলজিয়ামের পতাকাতলে চলে যাওয়ার সময় আবিষ্কার করে যে, পতাকা শুধু উল্টালেই হবে না… রঙের সিকোয়েন্সেও এদিক সেদিক আছে। এ ব্যাপারটি রঙ এবং রঙের সঠিক ধারাবাহিকতা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার দিকে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে।

আর্জেন্টিনা খুব একটা ভালো খেলতে না পেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে এবং ব্রাজিল বেশ ভালো খেলতে পেরেও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিলে দেশজুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তবে এ বছর ব্রাজিল ভালো খেললেও নেইমার কাণ্ডে ব্রাজিল সমর্থকরা খানিকটা ব্যাকফুটে আছেন। সামষ্টিকভাবে ভালো করেও, একজন ব্যক্তির ভুলকেই আমরা বড় করে দেখছি। যা প্রমাণ করে আমাদের সামাজিক পর্যায়ে কতটা অনাস্থা বিদ্যমান। প্রতিক্রিয়াশীলতার চূড়ান্ত নিদর্শন যেন একেকটা ফুটবল ম্যাচের আগে ও পরের অসুস্থ আলোচনা। 

তবে সবকিছুর পরেও বিশ্বকাপ শেষের ঘন্টা বাজছে। এখন শুধু অপেক্ষা কার হাতে উঠবে বিশ্বকাপের ট্রফি। ফরাসি মোরগের মাথার উপর কি দ্বিতীয় তারা বসতে পারবে, নাকি বিশ্ব পাবে নতুন এক তারকাসমৃদ্ধ জার্সি! সময়ই আমাদের জানিয়ে দেবে।কিন্তু বিশ্বকাপ উঠতে যাচ্ছে ইউরোপেরই এক দেশের হাতে, যা প্রমাণ করে বিশ্ববাণিজ্যের মতো আধুনিক ফুটবলেও ইউরোপই ধরে রেখেছে শ্রেষ্ঠত্ব ব্লা ব্লা ব্লা...

৭৮৭ পঠিত ... ১৩:৩২, জুলাই ১৫, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top