খুব সকালে মন খারাপ হলে কী করবেন? যখন ইস্কুল-কলেজ-অফিসটা যাবার আগে হাতে আধাঘণ্টা সময় আছে?
আমার পরামর্শ হলো- কোন মিষ্টির দোকানে ঢুকে যান!
যাহ!! মিষ্টি খেতে যাবেন কেন? আমি কি বলেছি মিষ্টির কথা? আপনি কি ছোট্ট সোনামনি নাকি ভরা ডায়াবেটিস নিয়ে কেডস পরে মর্নিং ওয়াকে বের হওয়া দাদুভাই যে স্যুট করে মিষ্টির দোকানে ঢুকে সাতসকালে কপকপিয়ে চমচম দিয়ে দিন শুরু করবেন?
মিষ্টির দোকানেই ঢুকবেন, তবে যে মিষ্টির দোকানে সকাল বেলায় পরোটা ভাজার তাওয়া বসায়, সেই দোকানে। আবার দেখে নেবেন ভালো করে, অনেকে আবার গণ্ডারের চামড়ার মতো পুরু পরোটা বানায়! সে দোকান বিষবৎপরিত্যায্য!
বাংলাদেশের একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো, এখানে মোটামুটি সব মিষ্টির দোকানেই মিষ্টি যেমন খুশি তেমন হোক, ডাল-ভাজি হয় স্বর্গীয় পর্যায়ের! ভালো ময়রা হবার আগে ভালো ডাল-ভাজি বানাতে হবে, এই দিব্যি দিয়ে নিশ্চয়ই তাদের চাকরিতে নেয়া হয় না!
আপনি খাস্তা পরোটা দেখে নিশ্চিত হয়ে ভেতরে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসবেন। এটা বাজারে রেস্তোঁরা না যে ওয়েটার এসে ঝুঁকে ঝুঁকে চৌদ্দ রকম পদের ফিরিস্তি দেবে। নিতান্ত নিরাসক্ত এক ছোকরা এসে জিজ্ঞেস করবে- ডালভাজি খাবেন না সুজির হালুয়া খাবেন? ডিম একটা ভাজি হবে নাকি না? ব্যস... শেষ!
আরেকটু পরামর্শ দেই? ডিমভাজিটা বরং বাদ দেন! পরোটা আনতে বলেন গরম গরম, আর ডাল-ভাজি!!
ঠকাস করে আপনার সামনে পড়লো পরোটা। ওদিকে টিনের থালায় করে সামনে দেয়া হয়েছে ডাল-ভাজি। একদিকে সবজির টিলা, আরেকদিকে ডালের স্রোত! একটার সাথে আরেকটা মিশিয়ে ফেলা হয়নি, আপনি আলাদা করে সবজি খুঁটে খুঁটে খাবেন নাকি একসাথে সব ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে খাবেন সেটা আপনার মর্জি! এই ভুবনে আপনিই আকবর বাদশাহ, মেলানিয়া ট্রাম্পের হাজব্যান্ড ডোনাল্ড ট্রাম্প!
আমার অনুরোধ- শুরুতেই পরোটা নিয়ে ভাজির থালায় হামলে পড়বেন না। গরম পরোটায় একটু ফুঁ দিন, কোনা ছিঁড়ে একটু মুখে দিন। সকালের খালি মুখে এই গরম ফ্রেশনেস ভালো লাগবে। মচমচে গুঁড়াগুলো একটু মুখে দিয়ে চিড়বিড় করুন। ক্রিস্পনেসটা উপভোগ করুন। পরোটারও যে আলাদা একটা আবেদন আছে, বেশিরভাগ সময় আমরা সেটা ভুলে যাই!
এবার আসুন মনোযোগ দেয়া যাক ডাল-ভাজিতে! আপনি কোনদিক দিয়ে শুরু করবেন? সবজির ধু-ধু মরুভূমিতে? নাকি ডালের সরোবরে? ছোট্ট সাজেশন ব্রাদার- পরোটার টুকরোটা মাঝের মিলনমেলায় একটা গুঁতো মেরে নিন!
তারপর মুখে দিন! মুখে কী হবে তা আমি বলতে যাবো না, এইসব সবিস্তারে বলতে গিয়ে আমি খারাপ হয়ে গেছি। রসিকতা করছি না, ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনকে চিনি যারা আমাকে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় ত্যায্য করেছেন!
ডাল-ভাজির বাটি নিয়ে বসে আমি মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, কী এমন জিনিস এতে আছে? সামান্য আলু, কুমড়া, পেঁপে, গাজর এইসবই তো! এরপরেই এই জাদুর স্বাদ আসে কিভাবে?
পাঁচফোড়নের স্বাদ টের পাওয়া যায়, আবার পাঁচফোড়ন দিয়ে একেবারে পাঁচপ্যাঁচে করে ফেলেনি! খুঁজলে শুকনা মরিচ বের হয় একটা-আধটা। আর কী আছে?? আমি খুঁজে আকুল হই।
ডালেরও বাহার দেখো! গোটা গোটা ছোলা প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে নেই! আবার হোটেল রেস্তোঁরার মতো ঝরঝরে তরল ভাবটাও নেই! কেমন যেন আঁঠালো একটা ডাল, পরোটার সাথে মাখিয়ে মাখিয়ে খাবার জন্য উপযুক্ত!
এই ডাল-ভাজির সাথে মচমচে পরোটার স্বাদ যে পেয়েছে, তার দুর্ভোগ আছে। ফ্রান্সে গিয়ে ক্রোঁয়াসো খেয়ে সে মুখ বাঁকাবে, ব্রিটিশদের আন্ডা-পোড়া টমেটো আর বিন খেয়ে তার কান্না আসবে, জার্মান জাওয়ার ক্রিট খেয়ে থম মেরে বসে থাকবে!
দু'টো পরোটা না হয় ডাল-ভাজি দিয়েই সাঙ্গ হলো। এবার হাঁক দিয়ে বলেন আরেকটা ভাজতে দিতে। ছোকরাটা এসে হয়তো আপনার ডাল-ভাজি রিফিল করে দিতে চাইবে! আপনি থামাবেন- উঁহু!! আপনার এখন রসমালাই দরকার! ঠাণ্ডা রসমালাই!!
ডিপ ফ্রিজ থেকে আগের দিনের রসমালাই বের হবে। তাতে একটা হলুদ মালাইয়ের ছোপ। আপনি গরম পরোটা ফুঁ দিয়ে ছিঁড়ে বরফ শীতল রসমালাই দিয়ে টপ করে মুখে পুরবেন।
লোকলজ্জা ভুলে যান! মিষ্টির দোকানে এমন কোন লাটসাহেব আসেননি যে আপনাকে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় হুশশ হুশশ শব্দ করতে দেখলে আপনার জাত যাবে। আগুন গরম আর বরফ ঠাণ্ডা একসাথে জিভে যে কী অসহ্য পরিমাণ সুখ দিতে পারে, আপনি মাত্রই সেটা টের পেয়েছেন। আমায় ধন্যবাদ দিন!
পরোটার ক্রিসপ ভেঙে আবার মালাই মেখে মুখে দিন। খোদার কাছে শোকর গুজারি করুন- আপনাকে বাঙাল ঘরে জন্ম দিয়েছে বলে, এই সুখ নাহলে কোথায় পেতেন??
খাওয়া শেষ করে রাস্তার গণমানুষের কাতারে আবার নেমে আসুন। নির্বিকারে ঠ্যালাধাক্কা দিয়ে একটা বাসে ঢুকে যান। অফিসে ঢুকে চুপচাপ কাজ শুরু করুন। গত আধাঘণ্টায় যে অবিশ্বাস্য সুখের মধ্য দিয়ে আপনি গিয়েছেন, তা মানুষের এতো শোনার সময় কার? আর আপনারই বা এতো শোনানোর কিসের ঠেকা, শুনি??
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন