ক্যাসিনো সেন্টিমেন্ট (প্যাসেজ টু হেভেন: পর্ব ২২)

৮৯ পঠিত ... ১৭:১০, জুলাই ০২, ২০২৪

39

বেহেশত কর্তৃপক্ষ আবার হুঁশিয়ারি বার্তা পাঠিয়েছে। গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরে 'সেন্টিমেন্ট' বিষয়ক জটিলতা এতটাই মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এদের বেহেশতে রাখা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের দপ্তর আশংকা প্রকাশ করেছে এই ‘সেন্টিমেন্ট' বেহেশতের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এটি শীঘ্রই নতুন নরকে পরিণত হবে।

এই খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরের চালাক-চতুর লোকেরা বেহেশতের অন্যান্য অংশে অভিবাসী হবার চেষ্টা করছে। এরা যেখানেই যাবে অন্তত সেন্টিমেন্ট সঙ্গে নিয়ে যাবে। সমস্যাটা সেখানেই।

দেবুদা সকাল সকাল বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বাসায় পৌঁছে যায়। এই সেন্টিমেন্ট ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে। কারণ এ নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলে উনি সেন্টিমেন্ট শব্দটিকে ইতিবাচক বলছেন। তাই যদি হবে তবে সেন্টিমেন্টাল গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরের এই হাল কেন যে তাদের সেন্টিমেন্টের ঠ্যালায় ওদের বেহেশতে রাখা যাচ্ছে না।

দেবুদা আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করে, আইনদা সেন্টিমেন্ট কী জিনিস?

: খুবই বাজে জিনিস; এটা একটা মেন্টাল ডিজঅর্ডার মাপার ধ্রুবক।

: মানে! সেন্টিমেন্টের সঙ্গে মেন্টাল ডিজঅর্ডারের সম্পর্ক কী! আপনার বন্ধু টেগোর বলছেন এটা পজিটিভ।

: ওখানেই বিজ্ঞানীর সঙ্গে কবির পার্থক্য । ভারতবর্ষের মেন্টাল ডিজঅর্ডারের কত রোগীর সেন্টিমেন্টের মূল্য তাকে দিতে হয়েছে। আর আমি জার্মান মেন্টাল ডিজঅর্ডারের রোগীদের সেন্টিমেন্টকে এতটুকু পাত্তা দেইনি। জীবন কেটেছে রসেবশে। আর টেগোর কত কষ্ট পেয়েছে ভেবে দেখুন।

: তা ঠিক। ভারতবর্ষে নরম মনের মানুষ জন্মানো যে পাপ।

: দেবুদা মেন্টাল ডিজঅর্ডার সেন্টিমিটারে মাপার ধ্রুবকটাই সেন্টিমেন্ট। একজন প্রেমিক এবং একজন সন্ত্রাসী দুজনেই মেন্টাল ডিজঅর্ডারের রোগী। পার্থক্য সেন্টিমেন্টে। প্রেমিকের সেন্টিমেন্ট যদি ৩ হয় তবে সন্ত্রাসীর সেন্টিমেন্ট ৯।

: আইনদা আপনি কি একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরে যাবেন। ওখানে কার কত সেন্টিমেন্ট একটু মেপে নেবেন!

: চলুন অসুবিধা কী! কিন্তু শুনেছি ওখানে নাকি সাদা চামড়ার লোক দেখলে মেরে ফেলা হচ্ছে।

: ওটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা আইনদা। আর আমি আছি তো ভয় কীসে!

গোবরডাঙ্গার কাছাকাছি পৌঁছুতেই দূর থেকে কর্কশ ঝগড়ার শব্দ ভেসে আসে।

এক লোক আরেক লোককে কলার চেপে ধরে মালাউন বলে গালি দিয়ে দিল। উত্তরে লোকটি এ ব্যাটা নেড়ে বলে কলার চেপে ধরল।

আইনস্টাইন বলেন, দেবুদা এটা কী হচ্ছে?

: ও কিছু না হিন্দু-মুসলমান খিস্তি খেউড়।

: ও আচ্ছা ৮ সেন্টিমেন্ট । কোনোভাবে মেন্টাল ডিজঅর্ডার বেড়ে ৯ সেন্টিমেন্ট হলেই এরা সন্ত্রাসী হয়ে যাবে ।

এক মহিলা চিৎকার করে আরেক মহিলাকে গালি দিচ্ছে, তুই তো পাঞ্জাবী তুই কালচারের কী বুঝিস!

উত্তরে পাঞ্জাবী মহিলা গালি দিচ্ছে, এ তামিলনাড়ুর কালচার আমার জানা আছে; নিজের চেহারা দেখ আয়নায় ।

আইনস্টাইন জিজ্ঞেস করেন, এদের ঝগড়ার সাবজেক্ট কী!

: এটা ৫ সেন্টিমেন্ট । উন্নাসিকতার রোগ।

সামান্য এগিয়ে যেতেই দেখে এক উর্দুভাষী এক পাঠানকে বলছে, তোর মতো বুদ্ধু পাঠানের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না।

পাঠান ভেঙচি দিয়ে বলে, তোর তো খালি চোপার জোর, পারবি গায়ের শক্তিতে ।

আইনস্টাইন জিজ্ঞেস করেন, এটা কী কেস?

: ৫ সেন্টিমেন্ট আইনদা।

: বাহ এই তো দিব্যি শিখে গেলেন সেন্টিমেন্টের হিসেব কষাটা। এ আসলে কঠিন জিনিস না।

গোবরডাঙ্গা আর শিয়ালনগরের ক্রসরোডে রীতিমতো ক্রসফায়ার চলছে। শিয়া-সুন্নী গুলিবিনিময়।

: এটা কী ব্যাপার দেবুদা!

ইসলামেরই দুটি অংশের লড়াই।

: ৯ সেন্টিমেন্ট আর কী!

আর একটু দূরে কিছু দলিত লোককে গণপিটুনী দিচ্ছে একদল অপেক্ষাকৃত উচ্চবর্ণের হিন্দু। আইনদা বিস্ময় নিয়ে বলে, এ তো দেখছি দোজখের চেয়েও খারাপ অবস্থা। চারিদিকে ৯ সেন্টিমেন্ট।

শিয়ালনগরে ঢুকতেই শোনা যায় বিরাট ওয়াজ মাহফিল, ওয়াজকারী উচ্চস্বরে কাফেরদের গালি দিচ্ছে; আর দুনিয়া পিত্তলদি গান গেয়ে গেয়ে শ্রোতাদের লিবিডোতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

আইনস্টাইন চোখ বুঁজে বলে দেন, এটা ৯ সেন্টিমেন্টের সূতিকাগার |

একটু দূরেই এক গেরুয়া পরা সাধুবাবা একটা গাছতলায় বসে ধ্যানস্থ। হাতে ত্রিশূল। ভক্তরা অশ্রুসিক্ত নয়নে তার পদযুগল চুম্বন করছে।

দেবুদা বলে, এটাও ৯ সেন্টিমেন্টের সূতিকাগার।

অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে দেবুদা আর আইনস্টাইন একটা কফিশপে ঢোকে। সেখানে বেশ পৃথুল দুটি লোক একে অপরের সঙ্গে বচসা করছে।

: আমি বুয়েটের ছাত্র। আপনি আমার চেয়ে বেশি বোঝেন নাকি!

: আমিও ডিএমসির ছাত্র। আপনি কি আমার চেয়ে বোঝেন?

আইনস্টাইন বলে, বাপরে বাপ এরকম ৭.৫ সেন্টিমেন্ট তো জীবনে প্রথম দেখলাম। ওরা কী জানে টেগোর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েনি!

ওরা সেখানেই থামে না। একজন আরেকজনকে বলে, আপনি তো বরিশাইল্লা ।

: নোয়াখাইল্লার মুখে বরিশালের সমালোচনা মানায় না।

দেবুদা বলে, দেখেছেন আইনদা এদের ৫ সেন্টিমেন্টও আছে।

কফিশপের আরেক টেবিলে বচসা বেধেছে আরো দুজনের ।

: ওরে বাঙ্গাল শুদ্ধ করে বাংলাও বলতে শিখলিনে।

: ওরে ঘটি শুধু এয়েচি বয়েচি কইলেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না।

: তা তোর কাছ থেকে কী শিখবরে বাঙ্গাল!

: ঘটি তুই থাক তোর এয়েচি বয়েচি নিয়া; আমি চললাম।

আইন্সটাইন একটা সিগার ধরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ভারতীয় উপমহাদেশে মনে হয় ৫ সেন্টিমেন্টের নিচে লোকই নাই। এরা বেহেশতে এসেও এতটুকু বদলায়নি।

কফিশপ থেকে বেরিয়ে দেখা যায় দুজন দুর্বৃত্ত অকস্মাত এসে এক তরুণকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে চলে যায়।

আইনস্টাইন স্তম্ভিত হয়ে যান। দেবুদা খুব বেদনার সঙ্গে বলে, এটা লেটেস্ট। ১০ সেন্টিমেন্ট। অবিশ্বাসীদের হত্যা।

আইনস্টাইন বলেন, তাহলে মনে হয় এক্ষনি আমাদের শিয়ালনগর ছাড়া জরুরি।

দেবুদা ঈশ্বরের দপ্তরে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, ঈশ্বরানুভূতি বলে কোনো বিষয় কি আপনাদের দপ্তর অনুমোদন করে।

একজন কর্মকর্তা বলেন, জীবনে প্রথম শুনলাম মশাই এরকম কথা। ঈশ্বরানুভূতি।

আইনস্টাইন দেবুদাকে ডেকে বলে, দেখেছেন শিয়ালনগরে নতুন কাসিনো খুলেছে।

: তাই তো। চলুন দেখি কী হচ্ছে সেখানে।

আশ্চর্য ব্যাপার। দোজখের লোকজন সব এখানে। আবু আলা মওদুদী, গোলাম আজম, সাভারকার, নাথুরাম গডসেই এবং খন্দকার মুশতাক। জুয়ার বোর্ডে ছড়ানো চিপস। তাতে লেখা ৭, ৮, ৯ সেন্টিমেন্ট।

এক একজন জুয়ার বোর্ডে এক একটি কার্ড ফেলছে আর অষ্টহাসিতে ফাটিয়ে দিচ্ছে জুয়াঘর।

দেবুদা কর্তব্যরত বেহেশতের পুলিশকে জিজ্ঞেস করে, দোজখের মাল সব বেহেশতে কেন!

: আর বলবেন না। এরা তো নরককেও অশান্ত করে তুলেছিল। ঈশ্বরের দপ্তর থেকে তাই নির্দেশ এলো এদের গোবরডাঙ্গা আর শিয়ালনগরে নিয়ে আসা হোক। এ এলাকাতো আর বেহেশত নেই। দোজখের চেয়ে খারাপ অবস্থা। তাই এলাকার লোকদের এখান থেকে স্থানান্তরের আগে পর্যন্ত ক্রিমিনালগুলো এখানেই থাকুক।

: সর্বনাশ।

: এরা আবার ঈশ্বরের দপ্তরে মামলা করেছে। যেহেতু কাগজে কলমে গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগর এখনও বেহেশতের অংশ; এবং তাদেরকে এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। কাজেই তারা বেহেশত ছেড়ে যাবে না। কারণ বেহেশতে নাকি পাপ-পৃণ্যের হিসাব চলে না। মামুবাড়ির আবদার পেয়েছে আর কী। সারাক্ষণ এখানে বসে মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে

জুয়া খেলে আর প্যাঁচ কষে।

হঠাৎ গোলাম আজম চিৎকার করে বলে, ১০ সেন্টিমেন্ট।

মুশতাক, ব্রাভো ব্রাভো বলে খেঁকিয়ে ওঠে ।

আইনস্টাইন দৌড়ে কাসিনো থেকে বেরিয়ে যান। দেবুদাও আসে পিছে পিছে। হঠাৎই পথে পার্বতীর সঙ্গে দেবুদার দেখা। পার্বতী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, এই তুমি দেবুদা তুমিই আমাদের গোবরডাঙ্গা আর শিয়ালনগরবাসীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছো। তুমিই ঈশ্বরের দপ্তরের কাছে আমাদের শান্তিপ্রিয় মানুষদের সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছো।

: কী বলো পারু! চোখের সামনে এত সন্ত্রাসীকাণ্ড ঘটছে; আমাকে প্রমাণ করতে হবে কেন? আইনস্টাইনদাকে জিজ্ঞেস করো উনি কী দেখলেন।

: থাক থাক তোমরা সুশীল, তোমাদের চরিত্র আমার জানা আছে। তোমরা আছোই ষড়যন্ত্র নিয়ে।

আইনস্টাইন দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান। দেবুদা এসে ক্ষমা চায়।

: আইনদা কিছু মনে নেবেন না যেন।

: ৬ সেন্টিমেন্ট। 

ব্যালকনি থেকে হাত নাড়ে চন্দ্রমুখী। দ্রুত নেমে এসে বলে, দেবুদা তোমাকে নিয়ে আমার দুটো কথা বলার আছে।

: বলো।

: তুমি দেবুদা আমাদের গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগরের সাধুবাবা-পীর সাহেবদের নিয়ে যত্রতত্র যদি রসিকতা করো; সেটা আমার সেন্টিমেন্টে লাগে।

আইনস্টাইন মুচকি হেসে বলেন, ওহে দেবুদা পুরো গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগরটাই তো দেখছি অনুভূতির জুয়াঘর।

(চলবে)

 

শেষ পর্বের লিংক

২১তম পর্বের লিংক

 

৮৯ পঠিত ... ১৭:১০, জুলাই ০২, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top