মাদুর পেতে বসে আছে তিন অকাল-বুড়ি।
পা ছড়িয়ে, সামনে পানের বাটা। একজনের মাথার চুল কদমছাঁট। এক ভাসুর-ঝি নিয়মিত এর চুল ঘেঁটে দেয়। বিধবাদের চুল রাখতে নেই। এই প্রথা বন্ধ হওয়ার ঠিক পরের দশকটা ইনি দেখে যেতে পারেননি।
এই রমণীর চুল ছিল মেঘের মতন, নিতম্ব ছোঁয়া। স্বামীর মরদেহযখন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন এক দাই বড় কাঁচি দিয়ে কচ-কচ করে কেটে ফেলে দিল সেই চুলের রাশ।
ইনি বললেন, আমাগো টিয়াঠুটি গাছটার মতন অমন বড় আমগাছ আর দ্যাখলাম না এ-দেশে! অন্য একজন বললেন, চটাস-চটাস কইরা কত পুঁটিমাছ ধরতাম, মনে আছে? পাছ পুকুর। আছিল লক্ষ্মী। দুইখান গজাল মাছ, চেঁকির মতন বড়, একসাথে ভাইস্যা ওঠত।
আর একজন বললেন, এ দ্যাশের মাছে সোয়াদ নাই।
চুল-ছাঁটা মহিলাটি মাছ খাননি বহুদিন। এখন আর সেজন্য আপসোস করতেও ভুলে যান। মাছের চেয়ে গাছের গল্প তাঁর বেশি ভালো লাগে।
তিনি বললেন, টিয়াঠুটি গাছটারে কি কাইট্যা ফ্যালাইসে। কিছু শোনছেন? পুঁটি মাছের স্মৃতিকাতর মহিলাটি বললেন, আ লো বড়পিসি! দ্যাশটারেই কাইট্যা ফ্যালাইসে! আর তুমি কও গাছের কথা!
২.
একটিমাত্র গোলাপ ফুল আঁকা ছোট টিনের সুটকেশ নিয়ে যুবকটি ছেড়ে যাচ্ছে নিজের বাড়ি।
জায়গাটার নাম বাদু। শহর থেকে বেশিদূর নয়, তবে শহরের লকলকে জিভ এখনও এ-পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাদের একান্নবর্তী পরিবার, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নিয়ে প্রায় আঠাশ জন। প্রায়। কেন? মানুষ কি প্রায় হয়? একজন দুজন করে বাড়ে, দুজন-তিন জন কমে। অর্ধচন্দ্রাকারে সাত খানা ঘর, কয়েকটি পাকা, কয়েকটা কাঁচা। এদের বাজারে দু-খানা দোকান আছে। সংসারে অভাব নেই। দুবেলাই ভাত হয়, ফেনা ভাতে ঘি জোটে।
তবু সাদেক চলে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে।
এই বয়েসের সে-ই প্রথম বি.এ. পাশ। গ্র্যাজুয়েট ছেলে কি বাজারের দোকানে মশলা বিক্রি করতে বসবে? না তেলের ঘানি চালাবে। তা হলে আর এতটা লেখাপড়া শেখার দরকার কী ছিল?
সে ভদ্রলোকের মতন চাকরি করবে।
যুদ্ধের পর শুরু হয়েছিল ছাঁটাই। স্বাধীনতা মানে ছাঁটাই, চতুর্দিকে বেকারদের কলরব। সাদেক কি সেই কারণেই চাকরি পাচ্ছে না? নাকি সে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে বারবার শুধু মুসলমান বলে?
সরকারি কাজে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও, টিউশনি। অনেক বেকার ছেলেই টিউশনি করে, যেমন তার কলেজের কয়েকজন বন্ধু। কিন্তু সাদেককে কেউ রাখে না। এদিকের মুসলমানদের। মধ্যে লেখাপড়ার তেমন চল নেই, বাড়িতে মাস্টার রাখবে? সাদেক মধ্যমগ্রাম, বারাসতে গিয়েও টিউশনি করতে রাজি আছে। কিন্তু হিন্দু বাড়িতে তার নাম শুনলেই নানান ছল-ছুতো দেখায়। কেউ বলে, আমরা মেয়ে-মাস্টার রাখব ভেবেছি। কেউ বলে, একজন এম.এ. পাশ এইটাকায় রাজি হয়ে গেছে।
দাঙ্গার আগুন লাগেনি এ-পল্লীতে, বাড়িতে অন্নবস্ত্রের অভাব নেই, তবু সাদেক মায়ের কান্না, বাবা-দাদার নিষেধ অগ্রাহ্য করে চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। মানুষ কি ভাগ্য পরীক্ষার জন্য দেশান্তরে যায় না? কিন্তু সাদেকের বুক-ভরা অভিমান, আর মুখে অপমানের ময়লা ছাপ।
৩.
এইখানে গোবিন্দ গাঙ্গুলির স্বপ্ন লেগে ছিল। এইখানে এখনও ভেসে বেড়ায় গোবিন্দ গাঙ্গুলির দীর্ঘশ্বাস।
এইখানে পুকুরের জল ছিল কাকচক্ষু, স্নিগ্ধ। এখন পানায় ভরতি, জল দেখাই যায় না। এইখানে মন্দিরে ঘণ্টা বাজত সকাল ও সন্ধ্যায়, এখন একটা অশ্বত্থ গাছ দৃঢ় আলিঙ্গনে গুঁড়িয়ে দিয়েছে মন্দিরের চূড়ো।
এ-দেউলে আর দেবতার মূর্তি নেই, ঘুরে বেড়ায় দুটো সাপ।
৪.
বেলেঘাটার সেই বস্তি এখন চেনাই যায় না।
এখানে প্রধানত থাকত ধুনুরিরা আর দরজির দল। সবই খাপরার চালের ঘর, সরু-সরু গলি। এ বস্তির মালিক ছিল মল্লিকবাবুরা, আর অধিবাসীরা মুসলমান। এখন সেখানে একটা দোতলা বাজার আর পাশে একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। পাড়ার ছেলেদের খেলার মাঠ।
সেই সে-বারে রাজাবাজার ও মানিকতলার প্রতিযোগিতা! খেলার নয়, খুনোখুনির। এদিকে নাড়ায়ে তকদির, আল্লা হো আকবর। ওদিকে বন্দেমাতরম! ভারতমাতা কি জয়! মাঝখানে। রক্তের স্রোত। রাস্তায় পড়ে থাকা লাশের পচা গন্ধ। সে প্রতিযোগিতা গড়িয়ে এল বেলেঘাটার। বস্তি পর্যন্ত। ছলাৎছলাৎ করে কেরোসিন ছেটাবার শব্দ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব কিছু পুড়ে ছাই।
নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতায় এসেছেন হেদায়েত হোসেন। বয়েস হয়েছে অনেক। কিন্তু। কর্মদক্ষতা এখনও যথেষ্ট। হেদায়েত বেড়াতে আসেননি, এসেছেন ব্যাবসার কাজে। গেঞ্জির ব্যবসায় বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন চেহারায় ও জামানো টাকায়। আগে ওদিকে গেঞ্জির ব্যবসায় হিন্দুদের ছিল আধিপত্য, তারা অনেকেই পালিয়ে এসেছে এদিকে, সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে হেদায়েতের দেরি হয়নি।
কলকাতা থেকে কিছু মেশিনপত্র নিয়ে যাওয়া দরকার। সরাসরি বর্ডার দিয়ে পার হওয়া যায় না, তবে রাত্রির অন্ধকারের আড়ালে নদীপথে পৌঁছান যায় সাতক্ষীরায়। সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তারপর হেদায়েত একটু বেড়াতে এসেছেন বেলেঘাটায়। এখানেই কেটেছে তাঁর বাল্য ও কৈশোর।
বাজারের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন পাঁচতলা বাড়ির সামনে। দুটো ফুটফুটে বাচ্চা লোহার গেট দিয়ে উঠছে আর নামছে। হেদায়েতের স্পষ্ট মনে আছে, স্মৃতিতে দেখতে পাচ্ছেন ছবি। ওই পাঁচ তলা বাড়িটার জায়গাতেই ছিল তাঁর আব্বাজানের দরজির দোকান। সর্বস্বান্ত হয়ে সপরিবারে পালিয়েছিলেন ওপারে, শুধু ছোটছেলেটাকে নিয়ে যেতে পারেননি। হেদায়েতের কোলের ভাইটি ওই আগুনের বেড়াজাল থেকে বেরোতে পারেনি।
হেদায়েতের চোখ পানিতে ভিজে গেল। বুকে জ্বলছে আগুন। এই পাঁচতলা বাড়িটা কোনওক্রমে গুড়িয়ে দেওয়া যায় না?
৫.
এটা কয়েকজন অফিসারের একটা নিজস্ব ক্লাব। প্রকাশ্যস্থানে নয়, একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট, ধানমণ্ডিতে। করিমসাহেব থাকেন সরকারি কোয়ার্টারে। এই ফ্ল্যাটটা কিনে রেখে দিয়েছেন, এখন কোনও কাজে লাগছে না, পরে তো লাগবে। তাঁর আর-একটা বাড়ি আছে সাভারে।
ক্লাবের সদস্য ঠিক ন-জন, বাইরের লোকের আসার অধিকার নেই। মহিলাবর্জিত। এখানে দরজা বন্ধ করে মদ্যপান হয়, তাস খেলা চলে, অফিস পলিটিকসের প্রসঙ্গ তো আসবেই। উচ্চশিক্ষিত অফিসাররা পানাহার ও গল্পগুজবের মাঝে-মাঝে হঠাৎ মুখস্থ বলেন শেকসপিয়ারের দু-চার লাইন। কেউ গান ধরেন। মীর তাকি মীরের রচনা। এখন দেশে খুব বাংলা-বাংলা হুজুগ চলছে, এরা নিজেদের উর্দু জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন এক-একসময়।
করিমসাহেব এ-ফ্ল্যাটে কাজের লোকও রাখেননি। সপ্তাহেদু-দিনই শুধু আসর বসে। তিনি কোনও সাক্ষী রাখতে চান না। কে কখন খবরের কাগজওয়ালাদের কাছে লাগিয়ে দেবে, তার কি ঠিক আছে?
এমনকি ড্রাইভারদেরও বিশ্বাস করা যায় না।
কিন্তু সোডা-পানি, চানাচুর-বাদাম-কাবাব এসবও তো লাগে। আগে থেকে কিছু আনলেও ফুরিয়ে যায়।
একমাত্র ফিনান্স সেক্রেটারি হায়দার আলি তাঁর ড্রাইভারকে এসব কাজে লাগান। তিনি অত কিছু। পরোয়া করেননি। তা ছাড়া তাঁর ড্রাইভার কখনও মুখ খোলার সাহস করবে না। সে লোকটি অতি বিনয়ী। সাত চড়ে রা কাড়ে না।
ড্রাইভার সোডার বোতল নিয়ে এসেছে। হায়দার আলি বললেন, রাখেন, টেবিলের নীচে রাখেন। একটার ছিপি খুলে দ্যান।
প্রথম দিনই তাঁর সহকর্মী রফিকুল জিগ্যেস করেছিলেন, তুমি তোমার ড্রাইভারকে আপনি আজ্ঞে করো নাকি? দ্যাটস গুড হ্যাবিট।
হায়দার আলি বললেন, গুড না ব্যাড জানি না। হ্যাবিট ঠিকই। এ লোকটির বয়েস হয়েছে, আমাদের গ্রামেরই লোক, ওর নাম হরেন ভটচাইজ।
করিমসাহেব বললেন, ভটচাইজ মানে ভট্টচার্য? হিন্দু ভট্টচার্যরা ব্রাহ্মণ হয় না?
হায়দার আলি বললেন, রাইট। আপনি জানেন দেখছি। আমাদের গ্রামে তো বেশকিছু ঘর হিন্দু ছিল, এই ভটচাইজরা ছিল পূজারী বামুনের ফ্যামিলি। ছোটবেলা থেকে দেখছি তো, আমরা।
ওদের সম্মান করতাম। তারপর ফিফটির রায়টে পুরো হিন্দু এলাকাটা সাফ হয়ে গেল। ভেরি। আনফরচুনেট, ভেরি আনফরচুনেট। লোকগুলো ভালো ছিল। আমি ছোটবেলায় একে হরেনদা বলে ডাকতাম।
রফিকুল বললেন, এ লোকটা বেঁচে গেছে, তা ওপারে পালায়নি?
হায়দার আলি বললেন, কেন যায়নি কে জানে। মাটির মায়ায় বোধহয়। এখন তো আর এখানে পুরুতগিরিরও স্কোপ নেই। টাকাপয়সার টানাটানি।
করিমসাহেব বললেন, তুমি তা হলে পুজুরি বামুনকে ড্রাইভার রেখেছ? বেশ তো!
হায়দার আলি বললেন, আমাদের বাড়িতে রেখেছি বলেই ও এখনও বেঁচে আছে। আমার চাচা ওকে ড্রাইভিং শিখিয়েছিল। খুব কাজের লোক। আমার যখন কুক থাকে না, তখন এ-ড্রাইভার আমার জন্য রান্নাও করে দেয়।
করিমসাহেব বললেন, বামুন যখন, রান্না ভালো জানবেই!
হায়দার আলি বললেন, বিফের কারি এত ভালো বানায়, যে-কোনও হোটেলের চেয়ে… করিম সাহেব আপন মনে হেসে উঠলেন।
৬.
দাদা, কতদিন পর এ দেশে আসলেন?
এই ধরুন, ফর্টি এইটে লাস্ট এসেছি, তারপর এটা সেভেন্টি টু, উফ কতগুলি বছর কেটে গেছে!
এর মধ্যে আসতে ইচ্ছা করে নাই?
ইচ্ছে তো ছিলই মনের মধ্যে সবসময়, স্বপ্নও দেখতাম, কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই কি আসা যায়? মাঝখানে যে অদৃশ্য দেওয়াল ছিল এতদিন, অদৃশ্য হলেও বার্লিনের দেওয়ালের চেয়েও কঠিন।
আপনি তো আমাদের দ্যাশের মানুষ?
আমাদের বাড়ি ছিল রাজশাহী। কিন্তু এটা তো আর আমাদের দেশ নয়।
রাজশাহীর বাড়িতে এখন কেউ নাই?
এই সিক্সটি ফাইভ পর্যন্ত ছিলেন আমার ছোটমামা। তারপর তার বাড়িতে পুলিশ এসে ডাকাতি করল।
পুলিশ ডাকাতি করল? বলেন কী দাদা?
হ্যাঁ, এমনি ডাকাত হলে বলার কিছু ছিল না। ডাকাত তো সব দেশেই আছে। কিন্তু পুলিশ যদি রাত্তিরবেলা দল বেঁধে এসে জিনিসপত্র জোর করে কেড়ে নিয়ে যায়। মেয়েদের ধরে টানাটানি করে—তারপর কি আর থাকা যায়?
রক্ষকই ভক্ষক, হা-হা-হা।
তখন বেশ মজার ব্যাপার হত। রাজশাহী ছেড়ে যাওয়ার আগে আমার কাকা কলকাতায় একটা টেলিফোন করতে চেয়েছিলেন। আগেকার বাংলা তখন ছিল এপার বাংলা ওপার বাংলা। দুটো। আলাদা দেশ হলেও পাশাপাশি তো বটে। কিন্তু তখন কি ঢাকা থেকেও কলকাতায় টেলিফোন করা যেত?
জানি, জানি। সেই সময়টা কইলকাতায় ফোন করতে হইলে আগে কল করতে হইত লন্ডনে। লন্ডনে কোনও চেনা লোককে ধরতে পারলে, সে তখন কইলকাতায় কানেকশন কইরা খবরটা দিয়া দিত!
আমরা একে বলি, ঘুরিয়ে নাম দেখানো। ছেলেমানুষদের খেলা। বড়-বড় পলিটিশিয়ান, আর্মি জেনারেলরাও সেই খেলা খেলেছে।
দাদা, আপনে কিন্তু একদিন আমাগো বাসায় পায়ের ধুলো দেবেন।
আরে, কী যে বলেন! আমার পায়ে এখনও কলকাতার ধুলো। আমি এখানকার ধূলা মাথায় নিতে এসেছি। আমার দেশ না হোক, তবু তো জন্মভূমি!
৭.
প্রখ্যাত গায়ক সমর মিত্র সফরে এসেছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে।
তিনি শুধু গায়ক নন। একাত্তর সালের নমাস পূর্ব-পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর উদাত্ত দেশাত্মবোধক গানে মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালি শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর সমর মিত্র—এই দুজনের কণ্ঠে সংবাদ ও সঙ্গীত শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত সবাই।
সমর মিত্র এই প্রথম এসেছেন বাংলাদেশে। বহু জায়গায় দেওয়া হচ্ছে তাঁকে সংবর্ধনা, তাঁর গানের আসরে জনতা ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন বাড়িতে তাঁকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলছে। এক দিনে তিন-চার বাড়িতে খেতে যেতে হচ্ছে তাঁকে।
এক পত্রিকা সম্পাদকের বাড়িতে সন্ধেবেলা খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কিছুক্ষণ। হতবাক হয়ে গেলেন। এতসব পদ কি মানুষ খেতে পারে? মস্ত বড় টেবিল, তাতে খাদ্যবস্তুগুলি ভারি সুন্দর করে সাজানো, দেখতেই ভালো লাগে, কিন্তু সব একটু-একটু করে চাখাও অসম্ভব।
কী কুক্ষণে তিনি একবার বলে ফেলেছিলেন, যে তিনি শুটকি মাছ ভালোবাসেন। তাই প্রত্যেক বাড়িতে কতরকম যে শুটকি হয়! শাকে শুটকি, ডালে শুটকি, আলুভর্তা-বেগুনভর্তায় শুটকি, চিংড়ি শুটকি, বম্বে ডাক (লইট্টা) শুটকি! আর মাছও যে কত রকম। সিরাজগঞ্জের রুই, পদ্মার ইলিশ, মেঘনার চিতলপেটি, অতি তেলাল পাঙাস, বিশাল বিশাল গলদা, তারপর মাংসও পাঁচ রকম।
এ-বাড়ির গৃহকত্রী সুরাইয়া ভাবীর হাতের রান্নার খুব সুনাম। এবং যেমন তাঁর রূপ, তেমনি সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর।
সমর মিত্র বললেন, এ কী করেছেন, খাইয়ে-দাইয়ে মেরে ফেলতে চান নাকি?
সুরাইয়া ভাবী বললেন, আপনার বেটা যতটুকু ইচ্ছা নেন। জোর করব না। তবে বিফ করি নাই, আপনার ভয় নাই।
সমর মিত্র বললেন, ভয়? ছাত্রবয়েসে বিফ কাবাব আর রুটি খেয়েই তো বেঁচে থেকেছি। সবচেয়ে সস্তা ছিল।
প্লেটে সাদা ফুলের মতন একটু ভাত আর দু-তিনটি পদ তুলে নিয়ে সমর মিত্র একটা চেয়ারে বসলেন।
এক গুণমুগ্ধ তরুণী তাঁকে জিগ্যেস করল, স্যার, এখানে এসে আপনার কেমন লাগছে?
সমর মিত্র বললেন, এমন আত্মীয়তা, এমন ভালোবাসা যেন জীবনে কখনও পাইনি। এখানকার বাতাসেও যেন নতুন গন্ধ। স্বাধীনতার গন্ধ। অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের মধ্যে কী অপূর্ব উদ্দীপনা, এটা আমাদের ওদিকে দেখাই যায় না। তবে ভাই, তোমরা বড্ড বেশি খাওয়াও! আমাদের ওখানে কোনও কাগজের সম্পাদক বা মালিকের বাড়িতে এতরকম খাবারের ব্যবস্থা, চিন্তা করা যায় না। তারা এত বড়লোকও হয় না। এখানে যা এক-একটি বড়লোকের বাড়ি। দেখছি, বাপ রে বাপ, মাথা ঘুরে যায়!
পাশ থেকে একটি যুবক বলল, কিন্তু আপনাদের কলকাতায় নিউজ পেপার তো অনেক বেশি বিক্রি হয়?
সমর মিত্র বললেন, হ্যাঁ, শুনলাম তো, এখানে অনেকগুলি ডেইলি নিউজ পেপার কোনওটারই বিক্রি আমাদের ওদিককার কাগজগুলোর সমান তো নয়ই, বরং অনেক কম। কিন্তু এদিককার সম্পাদকরা অনেক বেশি বড়লোক।
ছেলেটি বলল, শুনেছি আপনাদের আনন্দবাজার গোষ্ঠী…
প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে সমর মিত্র বললেন, তোমরা যেমন আন্তরিক আতিথেয়তা দিতে জানো, হিন্দুরা অতটা জানে না। হিন্দুর বাড়িতে গেলে তোমাকে মোটে তিন-চার পদ খাওয়াবে।
যুবকটি বললেন, এখানে কিছুটা শো অফ করারও ব্যাপার আছে। এতগুলো আইটেম কেউই খেতে পারে না, তবু কিছুটা দেখাবার জন্য…
আবার প্রসঙ্গ বদলে সমর মিত্র বললেন, আমার মাঝে-মাঝে কী ইচ্ছে হচ্ছে জানো? তোমরা যদি থাকতে দাও, তালে আমি এখানেই থেকে যাই। এখানে সবাই বাংলা ভাষাকে এত ভালোবাসে, বাংলা সংস্কৃতি আমাদের দেশের মতন পাঁচমিশেলি নয়। এখানেই তোমাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইব।
অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল, থাকুন, থাকুন।
জানলার ধারে একটি আলাদা হলে বসে সাংবাদিক মিজানুর রহমান। তিনি খাবার নেননি, হাতে হুইস্কির গ্লাস। সব শুনছিলেন, এবার বলে উঠলেন, ও-কম্মোও করবেন না সমরবাবু! এখানে থাকার ইচ্ছেটা মন থেকে মুছে ফেলুন! আপনি যাকে ভালোবাসা বলছেন, সেটা আসলে ইনফ্যাচুয়েশন। বেশি দিন থাকে না, উবে যায়। আপনি এখানে থাকলে কিছুদিন পরেই কী হবে জানেন? অন্য গায়কদের সঙ্গে কমপিটিশন হবে। তারা আপনার পেছনে লাগবে। অন্য অনেকে, যারা আপনার সামনে মিষ্টি ব্যবহার করবে, তারাই পেছন ফিরলে বলবে, এই শালা মালাউন,। একে তাড়াও! আপনি যদি…
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সুরাইয়া ভাবী বললেন, মোটেই এগুলো ঠিক না। মিজান ভাই বড় উলটাপালটা কথা বলেন।
পত্রিকার সম্পাদকমশাই বললেন, আমাদের মিজান সাহেব এক নম্বরের সিনিক!
মিজানুর রহমান বললেন, যা সত্যি, তাই বলছি! ইতিহাস থেকেই এর শিক্ষা নিতে পারেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান আর্মি, পশ্চিমবাংলার মানুষ অনেক সাহায্য করেছে। তখন এখানে কত উচ্ছ্বাস, গলা জড়াজড়ি, ইন্ডিয়ানরা আমাদের বন্ধু। বাঙালি-বাঙালি ভাই-ভাই, কিন্তু এসব কতদিন? নাৎসি-জার্মানদের হাত থেকে ফ্রান্সকে উদ্ধার করেছিল আমেরিকা, তার। কয়েকমাস পরেই ফরাসিরা আমেরিকানদের দেখে ঘেন্নায় মুখ কুঁচকেছে না? আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ইন্ডিয়ান আর্মির আঠারো হাজার সোলজার প্রাণ দিয়েছে, এই মাটিতে গোর রয়েছে তাদের। দেখবেন, একসময় সেকথা সবাই ভুলে যাবে, হিস্ট্রি বইতে তাদের প্রাণ দেওয়ার উল্লেখ থাকবে না। এমনকী ইন্ডিয়া যে কিছু সাহায্য করেছিল, সে-কথাও উচ্চারণ করতে চাইবে না কেউ। এই রকমই হয়।
দু-তিনজন একসঙ্গে প্রতিবাদ করলেন।
সমর মিত্র বললেন, আমারও মনে হয়, আপনি বেশি-বেশি পেসিমিস্টিক কথা বলছেন। ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের মধ্যে পলিটিক্যাল সম্পর্ক কী হবে জানি না, কিন্তু দু-দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ভালোবাসার সম্পর্ক–
তাঁর ভক্ত মেয়েটি তেজের সঙ্গে বলল, রাজনীতি বাদ দ্যান! বাংলা ভাগ হয়েছে, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির একটা মিলন সেতু আমরা ফিরে পেয়েছি, পাকিস্তানিরা তা থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে চেয়েছিল
সুরাইয়া ভাবী বললেন, সমরদা, আপনি থেকে যান আমাদের এখানে। আপনাকে আমরা ধরে রাখব। সবাইকে গান শেখাবেন। আমরাও যদি চান্স পাই, কলকাতায় একটা বাড়ি কেনার ইচ্ছা আছে। বছরের মধ্যে কয়েক মাস কলকাতায় গিয়ে থাকব।
মিজানুর রহমান গেলাসে আবার হুইস্কি ঢেলে হাসতে লাগলেন আপনমনে।
৮.
এলগিন রোডের পাশের একটা রাস্তায় বহুকাল ধরে দেখা যায় একটা হানাবাড়ি। আশেপাশে পুরোনো বাড়ি ভেঙে গড়ে উঠছে নতুন রূপের প্রাসাদ, শুধু মাঝখানের এই দোতলা ভাঙা বাড়িটা ঘিরে প্রচুর আগাছা জন্মে গেছে, জানলা দরজা অদৃশ্য। কলকাতার এই অঞ্চলে জমির দাম সোনার মতন।
বাড়িটার সামনে দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে পেছন দিকটা দেখাই যায় না, এত গাছপালা। নিশ্চয়ই বড় বাগান ছিল। একসময় ওখানে ফুটফুটে শিশুরা খেলা করত। লাল চটি পরা ফরসা রমণীরা বিকেলে গোল ছাতার নীচে বসতেন চায়ের আসরে। বেলজিয়ামের টি-সেট, কাটগ্লাসের গেলাসে রু-আফজার সরবত। ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান দেশ ভাগ হওয়ার কয়েক বছর পর পাড়ি দিলেন। পাকিস্তানে। পূর্বে নয়, পশ্চিমে। দলিলে কিছু গণ্ডগোল ছিল, তাড়াহুড়োতে বাড়িটা বিক্রি হতে পারেনি, ভেবেছিলেন পরে একসময় এসে ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান ভারতে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল।
ব্যারিস্টারিতে ভালোই পসার জমেছিল ইসলামাবাদে। তিনি সেখানকার একটি ছোটখাটো মন্ত্রীও হয়ে গেলেন। একাত্তরের গৃহযুদ্ধের সময় বাঙালি হিসেবে তিনি হলেন সরকারের চোখে সন্দেহভাজন, মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁকে মনে করত বিশ্বাসঘাতক। একেবারে যাকে বলে না-ঘরকা-ঘাটকা। বাংলাদেশে ফেরার উপায় নেই। ভারতেও না, পাকিস্তানেও টিকতে পারবেন না বেশিদিন, এর মধ্যে মুজাহিদিনদের সঙ্গে দাঙ্গার মধ্যে পড়ে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হল তাঁর ছোট ছেলেটি। তার পরই তিনি সপরিবারে সাগর পাড়ি দিয়ে চলে গেলেন লন্ডনে। তাঁর দুটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে, তারা কেউ বাংলা বলে না, বৃদ্ধ মনিরুজ্জামানও হারিয়ে গেলেন বাঙালি জীবন থেকে।
মনিরুজ্জামানের স্ত্রীর এক ভাই, অর্থাৎ শ্যালক হাবিবুল্লাহ, তাঁর সেজোছেলে কামাল। এদের বাড়ি চন্দননগরে। হাবিবুল্লাহ ছিলেন জজকোর্টের উকিল, কামাল চাকরি করে একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে। চন্দননগর থেকে যাতায়াতের খুব অসুবিধে, সদ্য বিয়ে করেছে তহমিনাকে, সেও পড়ায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সুতরাং ওদের একটা ফ্ল্যাট দরকার কলকাতায়। তহমিনার স্কুলটি সার্দান অ্যাভিনিউতে, সুতরাং ফ্ল্যাটটি ওই অঞ্চলে পেলেই ভালো হয়।
কামাল তার পারিবারিক সূত্রে জানে, এলগিন রোডের কাছে ওই অনেকটা জমির ওপর
পোড়োবাড়িটা তাদেরই এক আত্মীয়ের। সে যদি ওই বাড়িটার দখল পেত, তা হলে প্রোমোটারকে দিলে এগারো তলা মাল্টিস্টোরিড হয়ে যেত, তার গোটাকতক ফ্ল্যাট বিক্রি করলেই আর চাকরিবাকরি করতে হত না, সারাজীবন পায়ের ওপর না দিয়ে। সরকার এ বাড়ি অধিগ্রহণ করেনি, রিফিউজিরা এ-পাড়া পর্যন্ত পৌঁছায়নি, সেজন্য জবরদখলও হয়নি। এখন। সেখানে আগাছার চাষ হচ্ছে।
কামালের কাছে দলিলপত্র কিছুই নেই। ও বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে-যেতে তার শুধু দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
কামালকে তার বন্ধু শামসের বলেছিল, পার্ক সার্কাসের দিকে বাড়ির খোঁজ কর মোছলমান পাড়ায়, অন্য পাড়ায় বাড়ি পাবি না। কামাল বিশ্বাস করেনি। চন্দননগরে তো তারা হিন্দু পাড়ার মধ্যেই থাকে, কলকাতা আজো কসমোপলিটান শহর, সেখানে আবার পাড়া-ফাড়া আছে নাকি?
কিন্তু সাদার্ন অ্যাভিনিউ, বালিগঞ্জ, যোধপুর পার্কে একটার পর একটা জায়গায় তাকে ব্যর্থ হতে হল। পুরো ভাড়া, এমনকি ডিপোজিট দিতে রাজি থাকলেও কেন সে প্রত্যাখ্যাত হয়, সে কারণটাই দুর্বোধ্য।
শেষপর্যন্ত আশার আলো পাওয়া গেল তহমিনার এক ছাত্রী বিশাখার কাছ থেকে। বিশাখা জানাল যে তাদের যোধপুর পার্কের বাড়ির একতলায় ভাড়াটেরা উঠে গেছে, বাবাকে সে বললেই রাজি হয়ে যাবে।
তহমিনা আর কামাল দুজনেই এক রবিবার সকালে গেল বাড়ি দেখতে। নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন এলাকা, ফ্ল্যাটটাও আলো হাওয়া সমন্বিত, পছন্দ না হওয়ার কোনও কারণই নেই। ডিপোজিট লাগবে না, ভাড়াও যুক্তিসঙ্গত। বিশাখার বাবা রঙ্গনাথ বাজার করতে গেছেন, তিনি মৎস্যরসিক, গড়িয়াহাট-লেকমার্কেট ঘুরে-ঘুরে বাছাই করা মাছ নিয়ে আসেন, তাই দেরি হয়।
বিশাখা এর মধ্যে তহমিনা ও কামালকে কেক, পেস্ট্রি ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করল।
রঙ্গনাথ ফিরতেই বিশাখা বলল, বাবা, এই আমার স্কুলের মিস।
কামাল উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বলল, আর আমি এই মিসের মিস্টার!
পটে আরও চা আছে, রঙ্গনাথ চা খেলেন ওদের সঙ্গে। হাসি-ঠাট্টা গল্পগুজব করলেন খানিকক্ষণ।
তারপর বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের দিতে পারলে ভালোই হত, কিন্তু মুশকিল কী হয়েছে জানেন, আমার তো চায়ের ব্যাবসা, অফিসটা খিদিরপুরে, সেখানে আর জায়গা হচ্ছে না। স্টাফও বেড়ে গেছে। তাই এ-ফ্ল্যাট আর আমি ভাড়া দেব না। আমার অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টটা এখানে সরিয়ে আনব। খুবই দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না।
বিশাখা ওদের দুজনকে পৌঁছে দিতে গেল ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড পর্যন্ত।
ফিরে এসে দেখল, রঙ্গনাথ তখনও দাঁড়িয়ে আছেন কামালের নামের কার্ডটা হাতে নিয়ে।
বিশাখা বলল, বাবা, তুমি সত্যিই এখানে অফিস করবে? আগে বলোনি তো?
রঙ্গনাথ বললেন, তা এখনও ঠিক নেই। তা বলে মুসলমানকে ভাড়া দেব নাকি! ওদের বিশ্বাস নেই।
বিশাখা বলল, না বাবা, আমার মিসের কথাবার্তা শুনে কিছুই বোঝা যায় না। খুব ভালো ব্যবহার।
এত ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন।
রঙ্গনাথ বললেন, ভালো তো হোক না ভালো। নিজেদের মধ্যেই থাক না। ফিরে চলে যাক। পাকিস্তানে, ওদের ঢাকায়, সেখানে আরও ভালো থাকবে।
বিশাখা বলল, বাবা, ঢাকা তো পাকিস্তানে নয়। এখন বাংলাদেশে। তুমি কী যে বলো!
রঙ্গনাথ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ওই একই হল। এর মধ্যেই তো আবার হাফ পাকিস্তান হয়ে গেছে শুনেছি!
৯.
মাঝপথে অফিস ছুটি হয়ে গেল। দারুণ দুঃসংবাদ।
সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে হেনা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছে। এর মধ্যে ট্রাম-বাস বন্ধ হতে শুরু করেছে, প্রাইভেট গাড়িগুলো পালিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। হেনা কোনওক্রমে একটা বাস পেয়েছিল, একদল লোক হল্লা করে থামিয়ে দিল বাস মাঝপথে।
এখান থেকে তার বাড়ি বেশি দূরে নয়, হেনা প্রায় দৌড়তে লাগল। একবার তার হাত থেকে পড়ে গেল ছাতাটা। সেটা তুলতে গিয়ে তার ভয় হল, পেছন থেকে কেউ যদি তার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাড়িতে ঢুকেই সদর দরজাটা চেপে বন্ধ করে কাজের লোক সইফুলকে বলল, খবরদার আর
দরজা খুলবি না! যে-ই আসুক! ওপরে এসে দেখল, তার স্বামী আলম একটা গল্পের বই পড়ছে! কয়েকদিন ধরে তার জ্বর। সে অফিস যাচ্ছে না।
হেনা হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, তুমি রেডিও শোননি? নিশ্চিন্তে শুয়ে আছ? জানেনা কী হয়েছে?
কী?
ইন্দিরা গান্ধি মারা গেছেন। মানে তাঁকে খুন করা হয়েছে।
আলম ধড়ফড় করে উঠে বসে বলল, অ্যাঁ? কী বলছ? কে মারল? কোনও মুসলমান!
ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠল।
ওদিক থেকে একজন বলল, হেনা আপা, বাড়িতে ফিরে এসেছ! খবরদার, আর বাইরে বেরিয়ো না। জানো কী হয়েছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি! কে মেরেছে বল তো?
তা এখানে ডিটেইলসে জানায়নি, প্রথম খবর দিয়েছে বি.বি.সি.। আমাদের রেডিও স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। বি.বি.সি. জানিয়েছে, ওরই কোনও বডি গার্ড।
ফোন রেখে দিয়ে হেনা আলমকে জিগ্যেস করল, ইন্দিরা গান্ধির বডি গার্ডদের মধ্যে মুসলমান আছে?
আলম বলল, নিশ্চয়ই আছে। মুসলমান, শিখ, আরও কত জাতের লোক রেখেছেন।
কিন্তু এক জন মুসলমান ইন্দিরা গান্ধিকে খুন করবে কেন?
করতেই পারে। হতে পারে পাকিস্তানের এজেন্ট। ইন্ডিয়ার অনেক মুসলমানেরও খুব রাগ আছে ইন্দিরা গান্ধির ওপর।
কেন, উনি তো কমিউনাল নন। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় কত সাহায্য করেছেন—
সেইজন্যেই তো। উনি যে পাকিস্তানকে দুটুকরো করে দিলেন, তা বেশিরভাগ মুসলমানই পছন্দ করেনি। বিশেষত নর্থ ইন্ডিয়ার মুসলমানরা। এমনকী আমাদের মধ্যেও…করিম চাচা সর্বক্ষণ
বলে না, এটা হিন্দু ডিপ্লোম্যাসি!
খুনি যদি মুসলমান হয়?
তা হলে উন্মত্ত জনতা মুসলিম খুন করতে শুরু করবে। যাকে যেখানে পাবে। তারপর শুরু হয়ে যাবে দাঙ্গা।
আমার তো ইন্দিরা গান্ধিকে খুব পছন্দ ছিল। পাকিস্তান ভেঙেছেন বেশ করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব-পাকিস্তানে অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল না? শেখ মুজিবকে কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী করল না। তা ছাড়া ওখানকার বাঙালিরাই তো আগে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল।
তুমি পছন্দ করলেই তো হবে না। এর আগের ইলেকশানে ইন্দিরা গান্ধি হেরে গেলেন কেন? পুরো মুসলিম ভোট তাঁর বিরুদ্ধে গেছে। সেইজন্যেই যদি কোনও পাগল ধর্মান্ধ মুসলমান হঠাৎ গুলি চালিয়ে দেয়—
আবার দাঙ্গা হবে?
রাস্তায় কারা যেন বিকট চিৎকার করে ছুটে যাচ্ছে, ভয়ে কেঁপে উঠছে হেনা।
আলম বিমর্ষমুখে বসে আছে রেডিও খুলে।
বিকেলের দিকে জানা গেল, ইন্দিরা গান্ধির আততায়ী মুসলমান নয়, শিখ। তিনি শিখ উগ্রপন্থীদের ধরবার জন্য স্বর্ণমন্দিরে সৈন্য ঢুকিয়েছিলেন, তাঁর দেহরক্ষীদের মধ্যে থেকেই একজন শিখ গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তাঁর শরীর।
সারা ভারতে শুরু হয়ে গেছে শিখনিখন যজ্ঞ। দিল্লিতে শিখদের বাড়িঘর জ্বলছে। কলকাতায় এ ব্যাপার অবশ্য বেশিদূর ছড়াতে পারল না, পুলিশ থামিয়ে দিল দৃঢ় হাতে। কিন্তু শিলিগুড়িতে ক্রোধান্ধ হিন্দুরা জ্বালিয়ে দিয়েছে পেট্রল পাম্প, সেই আগুনে ঠেলে দিয়েছে ওই পাম্পের মালিক বৃদ্ধ সর্দারজিকে।
মুসলমান নয়, শিখ এ-সংবাদ পাকাঁপাকি জানার পর একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে গিয়েও মুখখানা কালো করে রইল হেনা। এতক্ষণ ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর জন্য দুঃখবোধ করার বদলে সে নিজেদের নিরাপত্তার কথাই শুধু ভাবছিল। কোথাও কোনও গণ্ডগোল হলে, মারামারি বাঁধলে, পুলিশ গুলি চালালেই কেন মনে হয়, এই বুঝি দাঙ্গা বেঁধে গেল। এই বুঝি আততায়ীরা তেড়ে আসবে তার দিকে। শুধু মুসলমান বলেই এই নিরাপত্তাহীনতা, এই সবসময় চাপা আতঙ্ক, কেন, কেন? এই নাকি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
১০.
কলেজে ভরতির ফর্ম জমা দিতে গেছে রাবেয়া, কেরানিবাবুটি সেটা উলটে-পালটে দেখে বললেন, রিলিজিয়ানের জায়গায় কিছু লেখোনি কেন?
রাবেয়া বলল, আমার ধর্মটা আমার ব্যক্তিগত, তা সবাইকে জানাতে হবে কেন?
কেরানিবাবুটি বললেন, অত পাকামি করতে হবে না। লেখো!
রাবেয়া লিখল না। সেজন্য শেষপর্যন্ত তাকে যেতে হল প্রিন্সিপালের ঘরে।
প্রিন্সিপাল সব শুনে ঈষৎ বিদ্রুপ করে বললেন, ধর্মের কথা লিখতে চাও না? তা হলে লিখে দাও নাস্তিক।
রাবেয়া বলল, আমি তো নাস্তিক নই। আমার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু সেটা ফরমে লিখতে আমি বাধ্য হব কেন?
এটাই নিয়ম। আর এক জায়গায় তুমি লিখেছ, ম্যারেড। তোমার স্বামীর নাম কী?
স্বামীর নাম জানানও কি বাধ্যতামূলক? যাই হোক, বলছি, আমার স্বামীর নাম সত্যেন বসু চৌধুরী।
তা হলে তোমার পদবি পালটাওনি কেন? তোমার স্বামী হিন্দু?
তিনি হিন্দু কিনা আমি জানি না। তিনিই বলতে পারবেন। বিয়ে করলেই মেয়েদের পদবি পালটাতে হবে এমন কোনও আইন আছে?
দ্যাখো, তুমি অযথা আমার সময় নষ্ট করছ। ফর্ম ঠিক করে নিয়ে এসো। না হলে ভরতি হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই।
স্যার। আমি ভরতি হবই!
গায়ের জোর? তোমাকে কি দারোয়ান ডেকে বার করে দিতে হবে?
তা দিতে পারেন। আমি আবার কোর্টের আদেশ নিয়ে এ-কলেজে ঢুকব। দরকার হলে আমি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাব।
সত্যেন বসু চৌধুরী বিয়ের পর নিজেদের পারিবারিক বাড়ি ছেড়ে মধ্যমগ্রামে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। সরকারি ফ্ল্যাট, জাত-ধর্মের কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
রেশন কার্ডটা পালটাতে হবে। তার ইন্সপেক্টরবাবু বাড়িতে এসে বললেন, আপনারা স্বামী-স্ত্রী, আপনি মুসলমান মেয়ে বিয়ে করেছেন, দ্যাটস অল রাইট, কিন্তু স্বামী আর স্ত্রীর তো এক পদবি হতে হবে!
তাই নাকি! আমরা যদি না চাই?
সেটা তো চলবে না! এটাই নিয়ম।
কোথাকার নিয়ম? ব্রিটিশরা এই নিয়ম চালু করেছিল। এখনও সেটা মানতে হবে? জানেন কী, মুসলমানদের কোনও পদবিই হয় না। পুরোটাই শুধু নাম। আপনার দিদিমার নাম কি ছিল মনে আছে?
আমার দিদিমার নাম? তা দিয়ে আপনার…মানে সে-কোশ্চেন আসছে কী করে?
আমি বলতে চাইছি, আপানার দিদিমার নিশ্চয়ই কোনও পদবি ছিল না। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম কী ছিল জানেন? মৃণালিনী দেবী। কোথাও দেখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর লেখা আছে? সব হিন্দু মহিলাই আগে ছিলেন দেবী কিংবা দাসী। তার বদলে শুধু নামটাই ভালো নয়?
বিকেলে সত্যেন আবার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে বেরোল। যাবে এক বন্ধুর বাড়িতে। মাঝপথে বৃষ্টি নামল। কাছাকাছি আশ্রয় নেওয়ার মতন জায়গা নেই, ওরা গিয়ে দাঁড়াল একটা গাছতলায়। গাছতলায় দাঁড়ালেও বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। ওরা ভিজছে আর হাসছে। রাবেয়ার হাসি থামতেই চায় না।
মাঝে-মাঝে ওপরের দিকে তাকিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে চাইছে আকাশ। সব সময় আকাশের কথা মনে থাকে না, আকাশের দিকে তাকানোই হয় না। শুধু এইরকম সময়ই মনে হয়, আমরা সবাই এক আকাশের নীচে মানুষ!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন