আমাদের ছোটবেলার নারায়ণ দেবনাথ

১৩১৭ পঠিত ... ২১:৪২, জানুয়ারি ১৮, ২০২২

270353667_4892160640847143_5382521401648754113_n

আমার ছোটবেলায় আমাদের বাসায় ছোটাদের একটা পত্রিকা আসত। নাম শুকতারা। সেই পত্রিকার শেষের পাতায় একটা কমিকস থাকতো। এক পাতার একটা কমিকস; মাঝেমধ্যে দু’পাতা। নাম হাঁদা-ভোঁদা। সেই কমিকস কে আঁকত তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। মাথাব্যথা ছিল সেই কমিকসের দুই চরিত্র হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে। তাদের মতো হতে হবে। তাদের মতো কী কী দুষ্টুমি করা যায় এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত। একবার কী এক রোখ চাপল, হাঁদা (নাকি ভোঁদা)-র মত চুলের স্টাইল করতে হবে। মাথায় একগাদা নারকেল তেল ঢেলে আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে সেই চুলের স্টাইল করার চেষ্টা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন অতিরিক্ত তেল নষ্ট করার জন্য বড়দের কানমলা খেয়ে থামতে হল। কিন্তু নন্টে-ফন্টের মজার দুষ্টুমি কি আর থামে? তদ্দিনে নতুন চরিত্র চলে এসেছে নন্টে-ফন্টে। তারপর আসল 'বাটুল দি গ্রেট'। আসলেই গ্রেট, যার বুকে বুলেট লেগে ফিরে যায় পর্যন্ত।  

সত্যি কথা বলতে কি আমার ছেলেবেলাটা ঐ নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা আর বাটুল দি গ্রেটকে ঘিরেই যেন কেটে গেল। যখন একটু বড় হয়েছি, একটু আধটু ছবি আঁকতে শুরু করলাম। একবার ইন্টার ডিসট্রিক্ট ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে গেলাম! তখন মনে হল আমার এই প্রতিভা তো (!) কাজে লাগানো দরকার। কী করা যায়? ব্যস, প্রথম চিন্তাই এল ওই নন্টে-ফন্টের মতো কমিকস আঁকতে হবে। একটা নামও ঠিক করে ফেললাম ‘পটলা ক্যাবলা’। শুধু পটলা ক্যাবলাতে থেমে থাকলাম না। আরও দুই চরিত্র এলো 'পল্টু-বিল্টু'। তারপর এলো 'বিজ্ঞানী বঙ্কু'। দেখতে দেখতে যেন রাতারাতি কমিকস আর্টিস্ট হয়ে গেলাম। সেগুলো ছাপাও হতে লাগল আগানে বাগানে। তখন হঠাৎ মাথায় এল, আচ্ছা যার কারণে এই যে আমার কমিকস আর্টিস্ট হয়ে ওঠা, সেই লোকটা আসলে কে? কে নন্টে-ফন্টে আঁকত? কে হাঁদা-ভোঁদা আঁকত? বা বাটুল দি গ্রেট? তখন যেন নতুন করে একজকে চিনলাম; তিনি নারায়ণ দেবনাথ। বাংলা কমিকস আর্টিস্টদের অন্যতম গুরু নারায়ণ দেবনাথ।      

ভাবতে ভাল লাগে আমাদের উন্মাদের কার্টুনিস্ট (এবং বর্তমানে উন্মাদের নির্বাহী সম্পাদক) মেহেদী হক কমিকসে ‘নারায়ণ দেবনাথ’ পুরস্কার পেয়েছে। মেহেদী যখন নারায়ণ দেবনাথের হাত থেকে পুরস্কার নিতে কলকাতা গেল, তার সাথে দেখা করল, তখনও তিনি নিজেরর স্টুডিওতে বসে টুকটুক করে কমিকস এঁকে চলেছেন। আরও দু একজন আশেপাশে ভিড় করে তার আঁকা দেখছিল। এর মধ্যে কে একজন প্রশ্ন করে বসল, ‘দাদা আপনার মৃত্যু সংবাদ কবার যেন বের হয়েছিল পত্রিকায়?’ তিনি কমিকস আঁকতে আঁকতে গম্ভীর হলে বললেন, ‘তিনবার'। দু’য়েকজন হেসে উঠল।     

কিন্তু এবার আর ব্যাপারটা হাসির হল না। তিনি সত্যি সত্যি চলেই গেলেন। শত সহস্র শিশু কিশোরকে যিনি আনন্দ দিয়েছেন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, তিনি নেই। মেহেদীর কাছেই শুনেছিলাম, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশের শিশুরা কি তার কমিকস পড়ে?’ আহা, কী প্রশ্ন! তিনি যদি জানতেন বাংলাদেশেই তার অদৃশ্য হাত ধরে কতশত কমিকস আর্টিস্ট তৈরি হয়েছে! প্রিয় মেন্টর, আপনার সাথে দেখা হলো না এই জন্মে...এই আফসোস কোথায় রাখি আমি!

270461502_666792527689339_6234058409592032951_n

 

[নারায়ণ দেবনাথ: ‘হাঁদা-ভোঁদা,’ ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে-ফন্টে'র মতো বাংলা কমিকসের স্রষ্টা তিনি। নারায়ণ দেবনাথের জন্ম ১৯২৫ সালে হাওড়া শিবপুরে। গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে দেড় হাজারেরও বেশি সিরিয়াস ও মজার কমিকস সৃষ্টি করে বাংলার শিশু সাহিত্যে এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ‘শুকতারা’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করে বাঁটুল। বাঙালির প্রথম সুপারহিরো। তারপর একে একে তাঁর সৃষ্টি করা কমিকস চরিত্রগুলো নজর কাড়তে থাকে। তাঁর অসামান্য কীর্তির জন্য তিনি পেয়েছেন অজস্র সম্মান আর অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। ২০১৩ সালে ভারতের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত নারায়ণ দেবনাথ। আর ২০২১ সালে পান পদ্মশ্রী।  

২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি সকাল ১০টা ১৫ মিনিট নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নারায়ণ দেবনাথ।]

১৩১৭ পঠিত ... ২১:৪২, জানুয়ারি ১৮, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top