সালমান শাহ নয়, ইমন!

৯১৮ পঠিত ... ১৭:১৫, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০
 
সালমান শাহর সঙ্গে কখনো আমার কথা হয়নি। কয়েকবার দেখা হয়েছে। সেই দেখাটা একপাক্ষিক। মানে শুধু আমিই দেখেছি আর কি! তিনি আমাকে দেখেছেন দাবি করার পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ নেই।
 
আমি তাঁকে দেখা মাত্রই চিনেছি (যেন এটা বলবার মতো কোনো কথা!), তিনি আমাকে চিনতে পারেন নাই (যেন এটাও বলার মতো কোনো কথা!)। চাইলে কথাও বলা যেত। চেষ্টাই করিনি। নায়কদের দূর থেকেই দেখতে হয়।
 
সালমান শাহর সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি। তবে ইমনের সঙ্গে হয়েছে।
 
একই মানুষ, আবার এক নয়। বিফোর ক্রাইস্ট আর আফটার ক্রাইস্টের মতো ইমন আর সালমান শাহর মধ্যেও একটা বিভেদ রেখা আছে। সেই রেখার নাম 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত'।
 
সালমান শাহর সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি, আমাকে তিনি চিনতেনও না। ইমনের সঙ্গে কথা তো হয়েছেই, অন্তত একদিনের জন্য ইমন আমাকে চিনেওছিলেন। কারণ যে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচে ইমনের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা, সেই ম্যাচে ইমন আমার প্রতিপক্ষ দলে খেলেছিলেন এবং আমি তাতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলাম।
 
ম্যাচটা হয়েছিল বনানী ওয়াপদা কলোনী মাঠে। সালটা ১৯৯০-ই হবে। এর কিছুদিন আগেই ইঞ্জিনিয়ারিং পর্ব শেষ করে খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছি। জীবনযাত্রা খুব সরল। ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি করব কি করব না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা-ম্যাগাজিনে লেখালেখি করি আর শীতের সময়টায় নিয়মিত প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ খেলি। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির ব্যানারেই বেশি, সাপ্তাহিক পূর্ণিমাতে লেখালেখির সুবাদে দু'একটা দৈনিক ইনকিলাবের হয়েও। ইনকিলাব বনাম বিটিভির সেই ম্যাচে ইমন খেলেছিলেন বিটিভির হয়ে। মাঠেই কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন জানার পর সেই প্রসঙ্গটা আর বাড়তে দিইনি। কারণ ইমনের কোনো নাটকই আমি দেখিনি। তাঁকে সেটা জানতে দিতে চাইনি। তবে পরিচয় জানার আগেই ঝলমলে ওই তরুণকে দেখে মনে হয়েছিল, এ তো একেবারে নায়কের মতো দেখতে!
 
ইমনের না হয় বিটিভির সঙ্গে কোনো যোগসূত্র ছিল, তবে বিটিভি দলে এমন অনেকেই খেলেছিলেন, যাঁদের দলভুক্তিতে দেখানোর মতো কারণ ছিল একটাই---তাঁরা বিটিভি দেখেন! 'হায়ার' করা প্লেয়ার যাকে বলে। তখনই ঢাকা লিগে খেলেন বা পরে খেলেছেন, এমন একাধিক ক্রিকেটার ছিলেন বিটিভি দলে। শামিন আর তালহার কথা মনে পড়ছে। শামিন তখনই ফার্স্ট ডিভিশনে পিডব্লিউডিতে খেলেন, পরে খেলেছেন আবাহনীতেও। পেসার তালহা তখন কোথায় খেলতেন জানি না, পরে খেলেছেন বিমানের মতো দলেও। তা প্রীতি ম্যাচে তো এমন হতেই পারে। আমাদের দলেও খুব ভালো একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন। যাঁর কাভার ড্রাইভ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই আসিফ ইকবাল পরে ক্রিকেটার থেকে সাংবাদিক হয়ে গেছেন। সেই সূত্রে অনেক গল্প, অনেক আড্ডা ওই ম্যাচের আসিফকে ভুলতে দেয়নি।
 
শামিন আর তালহার কথা মনে থাকার কারণ অন্য। শামিন দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলেছিলেন। আমাদের দলের লেগ স্পিনার নাসিমুল হাসান দোদুলের এক ওভারেই দুটি না তিনটি বিশাল ছক্কা মেরে একরকম নিশ্চিতই করে ফেলেছিলেন বিটিভির জয়। বলটা আমিই কুড়িয়ে এনেছিলাম বলে মনে আছে, একটা ছক্কা মাঠের পাশের কচুক্ষেতে গিয়ে পড়েছিল। তালহাকে মনে আছে পিকনিক ক্রিকেটের সঙ্গে বেমানান বলের গতি আর দারুণ আউট সুইঙ্গারের কারণে।
 
শামিন-আসিফকে মনে থাকার আরেকটা কারণ আছে, তবে তা বলতে একটু বিব্রত বোধ করছি। আবার না বললেও চলছে না। ঘটনাচক্রে আমার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে যাওয়াটাকে জাস্টিফাই করতে যে এই দুজনের কথা বলতেই হয়। ২০, ২৫, নাকি ৩০ ওভারের ম্যাচ ছিল, এটা মনে করতে পারছি না। তবে এটা মনে আছে, আমাদের দলের অধিনায়ক বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার মোহাম্মদ মুসা যখন আমাকে বোলিংয়ে আনলেন, তখন বড়জোর আমি দুই ওভার বোলিং করতে পারি এবং বিটিভির জয়ের পক্ষে কাল্পনিক বাজির দর ১০০০-১ না হলেও নির্ঘাত ৫০০-১।
 
শেষ ওভারে বিটিভির কত রান লাগত মনে নেই, তবে অবশ্যই খুব বেশি নয় এবং শামিন তখনো উইকেটে। পরাজয় মেনে নিয়েই তাই ওভারটা শুরু করেছিলাম। প্রথম বলেই মিড উইকেটে চালাতে গিয়ে টপ এজ হয়ে গেল শামিনের (আমার এত মনে ছিল না, লিখতে পারছি আসিফ মনে করিয়ে দেওয়ায়), নতুন ব্যাটসম্যান তালহা নেমেই বোল্ড। আমার VVSM ( ভেরি ভেরি স্লো মিডিয়াম) বলে আগেই ব্যাট চালিয়েই বোধ হয় সর্বনাশ হয়েছে বেচারাদের। এর আগেই ২ উইকেট নিয়েছি। মোট ৪ উইকেট, ব্যাটিংয়ে কিছু রান আর শর্ট কাভারে ভালো একটা ক্যাচ---এই পারফরম্যান্সই ম্যান অব দ্য ম্যাচের দাবিদার, হারা ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ায় যেটি একেবারেই তর্কাতীত।
 
ইমন ওরফে সালমান শাহকে নিয়ে লেখা শুরু করে এই যে নিজের কথাই লিখে যাচ্ছি, এর বড় কারণ ওই ম্যাচে ইমন বলার মতো কিছু করেননি। করলে নিশ্চয়ই মনে থাকত। যা পরিষ্কার মনে আছে, তা হলো, প্রীতি ম্যাচের শেষে শুভেচ্ছা বিনিময় জাতীয় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিতে গিয়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। তখন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির বিল আর বাড়ি থেকে প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা এনে অনেক হিসাব করে চলি। এই মাসে আরও পাঁচ শ টাকা যোগ হবে ভেবে পুলকিত হয়েছিলাম। এর আগের প্রীতি ম্যাচগুলোতে ম্যান অব দ্য ম্যাচকে সেটাই পেতে দেখেছি। আমাকে চরম হতাশ করে এবার টাকার বদলে হাতে তুলে দেওয়া হলো বিশাল একটা ফ্লাস্ক। রাস্তায়-পার্কে ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতার কাছে যে ফ্লাস্কগুলো থাকে, ঠিক সে রকম। ফ্লাস্ক দিয়ে আমি করবটা কী? চা বিক্রি করব নাকি! টাকা হলে না কাজে লাগত! এখনো রেখে দেওয়া সেই ফ্লাস্কটা দেখলে এখন উল্টোটা মনে হয়। টাকা পেলে কি আর সেদিনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকত!
 
ওই ফ্লাস্কটা আমাকে যত না ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার গল্প বলে, তার চেয়ে বেশি ইমনের গল্প। নিষ্পাপ ওই সুন্দর মুখশ্রীর কারণেই অভিনন্দন জানিয়ে যাঁর হাত মেলানোটা আলাদাভাবে মনে আছে। নাকি মনে আছে সেই ইমন পরে সালমান শাহ হয়েছেন বলে!
 
 
লেখার সঙ্গে যে ছবিটা দেখছেন, পরদিন ইনকিলাবের খেলার পাতায় তা তিন কলাম জুড়ে ছাপা হয়েছিল। খেলোয়াড়ি কোনো কৃতিত্বের জন্য পত্রিকায় ছাপা হওয়া এটাই আমার প্রথম ও শেষ ছবি (বাকি সব ম্যাচের পারফরম্যান্স কহতব্য নয়)। বিটিভির মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল সৈয়দ ফ্লাস্কটি তুলে দিচ্ছেন আমার হাতে। পাশে দাঁড়িয়ে ইনকিলাব সম্পাদক বাহাউদ্দিন আহমেদ। তখন ইনকিলাবে কর্মরত যুগান্তরের বর্তমান সম্পাদক সাইফুল আলম ও ইনকিলাবের বিখ্যাত স্পোর্টস রিপোর্টার রেজাউর রহমান সোহাগকেও দেখা যাচ্ছে ছবিতে। হাততালি দিতে থাকা ডানের তরুণও সাংবাদিক, নামটা মনে করতে পারছি না।
 
কত কিছুই তো জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, খুঁজতে গেলে অনেক কিছুই আর পাই না। কীভাবে কীভাবে যেন এই ছবিটা এখনো রয়ে গেছে। যা দেখলে একটা দীর্ঘশ্বাসই পড়ে। মোস্তফা কামাল সৈয়দ কিছুদিন আগে চলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এক দুর্ঘটনায় এই ছবির আলোকচিত্রী মিজানুর রহমান তারও অনেক আগে। ছবিটা বড় প্রিন্ট করে তিনিই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এটি দেখলেই তাই তাঁর কথা মনে পড়ে। ছবিতে নেই, তারপরও ছবিটা দেখলেই মনে পড়ে সালমান শাহকেও।
 
ভুল বললাম, সালমান শাহ নয়, ইমন। সালমান শাহর সঙ্গে তো আমার কখনো কথা হয়নি। ইমনের সঙ্গে হয়েছিল।
৯১৮ পঠিত ... ১৭:১৫, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top