হুমায়ুন আজাদ ছিলেন সদা স্পষ্টভাষী, তা সকলেরই জানা। সমসাময়িক লেখকদের সাথে তার বন্ধুত্ব যেমন ছিল, তেমনি অনেকের সঙ্গে তাই মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ঘটনা ঘটেছে। তার বর্ণময় জীবন থেকে অন্য কবি-লেখকদের সঙ্গে কিছু অম্লমধুর ঘটনা তুলে আনা হলো eআরকির পাঠকদের জন্য।
১# 'হুমায়ুন আজাদ নারী বই বের করবেন। বের হতে দেরি হচ্ছে। বেশ কদিন পরে মেলায় বই এল। তাও আবার প্রচ্ছদ ছাড়া, সেটাও বিক্রি হয়ে যেতে লাগলো। আমি তাঁকে বললাম, ‘স্যার, আপনার বই তো প্রচ্ছদ ছাড়াই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘নারী তো প্রচ্ছদ ছাড়াই ভালো।’ তিনি রসিকতা করেছিলেন, আমি ছিলাম অতি তরুণ, সেটা কাগজে লিখে দিলাম। তিনি ভীষণ রাগ করেছিলেন। এটা কেন কাগজে লিখে দিয়েছ। কোনো কিছু লিখতে হলে অবশ্যই তা আগে থেকে জানাতে হবে যে এটা আমি প্রকাশ করব।'
আনিসুল হক
বইমেলার কয়েকটি মজার ঘটনা, দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
২# একবার বইমেলায় আহমদ ছফা শত শত মানুষের সামনে হুমায়ুন আজাদের স্ত্রীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, এই রকম মানুষের সঙ্গে যিনি ঘর-সংসার করতে পারেন, তিনি অবশ্যই প্রণম্য। আজাদ ও আহমদ ছফার সম্পর্কে তিক্ততা থাকলেও সেই সময়টাতে ছফার সঙ্গে আজাদের সম্পর্ক ততটা অম্ল হয়ে ওঠেনি। তাই হতে পারে সেদিনের সেই ঘটনাটি ছিল ছফা ও আজাদের পারস্পরিক স্নেহ ও হিউমারের একটি পরিচয়।
৩# একসময় দুই হুমায়ূনের (হুমায়ূন আহমেদ ও হুমায়ুন আজাদ) মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পরবর্তীতে তাদের বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে। হুমায়ুন আজাদ এক লেখায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ এবং তার বেশি বেশি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইতর প্রাণী প্রসব করে বেশি’ ধরনের মতামত প্রকাশিত হলে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, যোগাযোগই থাকে না। তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠেন। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজ বাসভবনেই আড্ডার আয়োজন করতেন। সেখানে হুমায়ুন আজাদ বিষয়ক গল্প করতেন। এই গল্পটি বহুবার বলেছেন, ‘আজাদ সাহেব আমাকে প্রায়ই বলতেন তোমার লেখা ভাল, কিন্তু গভীরতা নাই। একবার গভীরতা আনার জন্য আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প নিজ হাতে কপি করে নিয়ে গেলাম। শুধু চরিত্রের নামগুলোকে মুসলমান করলাম, পরিবর্তন শুধু এটুকুই। হুমায়ুন আজাদ এই গল্প পড়ে বললেন- হুম, সবই ঠিক আছে, গভীরতা একটু কম।’
৪# সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি তখন। হুমায়ূন আহমেদ শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। নিয়ম মতো হল-প্রভোস্টের সঙ্গে আবেদনকারীর একটি সাক্ষাৎকার দিতে হয়। হুমায়ূন সেখানে গেলেন। সঙ্গে ছিলেন আরেক হুমায়ূন, মানে হুমায়ূন আজাদ। কোথায় কী করতে হবে এ সব ব্যাপারে তাকে তখন আজাদই সাহায্য করছিলেন। এই সাক্ষাৎকার-পর্ব শেষে আজাদ হুমায়ূনকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায় এলেন। কী ব্যাপার?
ব্যাখ্যা দিলেন আজাদ। প্রভোস্ট হুমায়ূনকে অনেক প্রশ্ন করেছেন, অনেক কিছু বলেছেন। হুমায়ূন কিছু বলেননি। শেষে প্রভোস্ট তার বক্তব্য শুনতে চাইলে হুমায়ূন অম্লান বদনে বলে দিয়েছেন, ‘আপনাকে আমার এখন পেটাতে ইচ্ছা করছে।’ প্রভোস্টের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন।
আজাদ যখন ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন, হুমায়ূন তখন মাথা নিচু করে পাশে বসে আছেন। তার মানে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তিনি ‘অপরাধী।’
এত কিছুর পরও কিন্তু হাউস টিউটরের চাকরিটা হুমায়ূন পেয়ে যান!
৫# হুমায়ুন আজাদ একবার হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনকে একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করলেন। বইটির নাম ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। দুজনেই মনে করলেন, এখানে ঔপন্যাসিক হিসাবে তারা দুজনই নষ্ট, এমন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। মিলন প্রতিশোধের বাসনায় হুমায়ুন আজাদকেও একটি বই উৎসর্গ করলেন, বইটির নাম ‘বনমানুষ’। আজাদ এই ঘটনায় যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছিলেন এবং আহমেদ যথেষ্টই মজা পেয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র: সামহোয়ার ইন ব্লগ, বিডিনিউজ২৪ ও প্রথম আলো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন