ভোর ছয়টার সময় পেট্রলপাম্পের কাছে ঠেলাগাড়িতে বরফ ফেরিওয়ালার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। সাতটা পর্যন্ত লাশ পড়ে রইল রাস্তায়। ঠেলা থেকে বরফ গলে গলে পানি হয়ে পড়তে থাকল।
সোয়া সাতটা বাজলে পরে পুলিশ লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেল। বরফ আর রক্ত সেই রাস্তায়ই পড়ে থাকল।
পাশ দিয়ে একটা টাঙ্গা চলে গেল। তাতে বসা ছোট একটা বাচ্চা রাস্তায় জমে থাকা উজ্জ্বল থকথকে রক্তের দিকে তাকাল। ওর জিভে জল এসে পড়ল। সে তার মায়ের হাত টেনে আঙুল দিয়ে সে দিকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখ মা, জেলি!!’
গল্পের নাম জেলি আর গল্পের লেখকের নাম সাদত হাসান মান্টো। উর্দু সাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন সাদত হাসান মান্টো। এমন গল্প শুধু তার পক্ষেই লেখা সম্ভব। কখনও এসেছে ফতোয়া, কখনও আবার অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। বেঁচে থাকতে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেই সমানতালে অপমান করা হয়েছে মান্টোকে। দেশভাগের সময় নিজের জন্ম শহর বোম্বে(বর্তমান মুম্বাই) ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো পাকিস্তানের লাহোরে। যেখানে তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছটফট করেছেন নিজের জন্মভূমিতে ফেরত আসার জন্য। এতকিছুর মাঝে একটি জিনিস থামেনি, সেটি হচ্ছে মান্টোর কলম। যে কলম দিয়ে মান্টো লিখে গেছেন, ৪৭ এর দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশভাগের সময় মানুষের মনের কদর্যতা। সবকিছু কোনরকম ফিল্টার না করে, একদম চোখের সামনে যেমন ঘটেছে তেমনটাই লিখেছেন কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে। সবকিছুর চলমান ছবিকে একদম কাগজে কলমে আটকে রেখেছেন মান্টো। মান্টোর লেখা পড়তে পড়তে মনে হবে চোখের সামনে কোনো সিনেমা দেখছি। যে সিনেমায় মানুষ মানুষকে ভালোবাসে না, মানুষ মানুষকে পশুর মত করে মেরে ফেলে। বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৩ বছর কিন্তু ছোট সময়ের নিজেকে ছোট গল্পের একদম ঈশ্বরে পরিণত করেছিলেন মান্টো। প্রায় ২২টি ছোটগল্পের সংকলন লিখেছিলেন, এছাড়া ১টি উপন্যাস, ৭টি রেডিও নাটক, ৩টি প্রবন্ধ সংকলন আর ২টি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থও লিখেছিলেন মান্টো।
জাতিগতভাবে মান্টো ছিলেন কাশ্মীরী। জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় ১৯১২ সালের ১১ মে। মান্টোর বাবা গুলাম হাসান পাঞ্জাব সরকারের একজন মুন্সেফ, পরবর্তীতে জজ হন তিনি। তৎকালীন রেওয়াজ অনুযায়ী দুই বিয়ে করেছিলেন গুলাম হাসান। গুলাম হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী সর্দার হাসানের ঘরে জন্ম নেন
মান্টো। অমৃতসরের মুসলিম হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরু হয় তার। কিন্তু পড়ালেখায় অমনোযোগী মান্টোর স্কুলে দমবন্ধ হয়ে আসতো। ছাত্র হিসেবে মান্টো ছিলেন, কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না, উর্দু সাহিত্যের সেরা এই লেখক তিনবার উর্দুতে ফেল। চতুর্থবারের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে তার সাথে পরিচয় হয় তার্কিক আব্দুল বারি আলিগের। বারি আলিগের সাথে পরিচয় মান্টোর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি মান্টোকে ফরাসী এবং রাশিয়ান ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে এই দু’টি ভাষা শিখে মান্টো সে ভাষার বিখ্যাত বিভিন্ন গল্প অনুবাদ করতে শুরু করে। ১৯৩৪ সালে মান্টো ভর্তি হন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসময় থেকেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন মান্টো এবং ধীরে ধীরে ভারতের প্রভাবশালী সাহিত্যিকে পরিণত হন। ১৯৪৩ সালের মধ্যে বেশকিছু রেডিও নাটকও লিখে ফেলেন। মান্টোর জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরুও তখন থেকেই। দেশভাগের আগে তিনবার তাকে গল্পে অশ্লীলতা ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। একই অভিযোগ দেশভাগের পর পাকিস্তান গিয়ে পেতে হয়েছে তাকে। বারবার অভিযুক্ত হওয়ার পর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মান্টো বলেছিলেন, ‘একজন লেখক তখনই কলম ধরেন, যখন তার সংবেদনশীলতা বা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়!’
কাশ্মীরের মেয়ে সুফিয়াকে বিয়ে করেছিলেন মান্টো। তাদের ঘরে তিনটি মেয়ে এবং একটি ছেলে ছিলো। ছেলেটি অবশ্য ১ বছরের বেশি বাঁচেনি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ছোঁয়া এসে লাগে তার জীবনেও। মুসলমান হওয়ার কারণে বোম্বে টকিজ ফিল্ম থেকে চাকরি হারান, সেই সাথে পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে পালিয়ে চলে যান পাকিস্তানের লাহোরে শরণার্থী হিসেবে। পাকিস্তানে যাওয়ার পর নিজেকে একপ্রকার হারিয়েই ফেলেন মান্টো। কারণ বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আর পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে ছিলো আকাশ পাতাল ফারাক। এছাড়া সেখানে তার কোনো বন্ধু ছিলো না। আর লেখালেখির জন্য অপমানিত হওয়া তো ছিলো নিত্যনতুন ব্যাপার। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে রম্যরচনা আর ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। জীবনের প্রতি একপ্রকার বিতৃষ্ণা চলে আসে তার। পুরোপুরি মদে আসক্ত হয়ে থাকতেন, এমনকি সে সময় মদের টাকা জোগাতেই নাকি লিখতেন তিনি। ভালোবাসার শহর বোম্বে থেকে পালিয়ে আসা, আর দেশভাগের যন্ত্রণায় একদম অস্থির হয়ে পরেছিলেন মান্টো। বন্ধু ইসমত চুগতাইয়ের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কোনোভাবে আমাকে ফেরত নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।‘
লেখক হিসেবে পাকিস্তানে খুব বেশি একটা সম্মান পাননি মান্টো। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো সেখানে থাকতেই লিখেছেন তিনি। কারণ, সে সময়টায় তিনি নিজের দেশ হারানো, দেশভাগ, মানুষের বিভেদ আর নতুন পরিবেশের যন্ত্রণায় থেকে একদম নির্মম সত্যগুলো তুলে এনেছিলেন নিজের কলমে। ‘বু’, ‘টোবা টেক সিং’, ‘ঠান্ডা গোশত’, ‘তামাশা’ এগুলো মান্টোর উল্লেখযোগ্য রচনা। জীবদ্দশায় নিজের কাজের তেমন কোনো স্বীকৃতি পাননি মান্টো। একপ্রকার অবহেলিত, অ্যালকোহলের আসক্তি আর অভাবকে সাথে নিয়ে ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সাদত হাসান মান্টো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন