বেড়ানোর শখ কার আছে প্রশ্নটা না করে 'কার নেই' সে প্রশ্নটা করাই ভালো! তবে, একা একা কি আর ট্যুর হয়? দারুণ আনন্দময় ট্যুরের জন্য প্রয়োজন একটি মজার ট্যুর-দল! প্ল্যানিং-এর দিন ডজনখানেক মানুষ 'চল দোস্ত কালকেই যাই' বললেও শেষ পর্যন্ত যদিও বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চ-প্লেনে ওঠে গুটিকতকই, তবু প্রতিটি ট্যুরেই আপনার সঙ্গীদের মধ্যে নিচের চরিত্রগুলোর মধ্যে একজন না একজন কমন পড়ে যাবেই। যাবতীয় ট্যুর স্মৃতি হাতড়ে এরপর নিজেই মিলিয়ে নিন!
১#
এদের কাজ হচ্ছে পুরা পথে শুধু অভিযোগ করা। খাবারে লবণ বেশি কেন, বাস এত আস্তে চলে কেন, রাস্তায় এত জ্যাম কেন, আবহাওয়া এত গরম/ঠান্ডা কেন, হোটেলটা এত ময়লা কেন, হাতেপায়ে ব্যাদনা করে কেন- ইত্যাদি ইত্যাদি বলে সবার মাথা ধরিয়ে দিবে এরা। এরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখে বলে 'গর্ত এত ছোট কেন, ডিজনিল্যান্ড দেখতে গিয়ে বলে 'চারদিকে এত পুলাপান কেন', রকি মাউন্টেন দেখতে গিয়ে বলে 'পাহাড়ে গাছ নাই কেন', নায়াগ্রা দেখতে গিয়ে বলে, 'পানি পড়া দেখতে এত দূরে আসলাম কেন!'
২#
সবাই যখন রেডি হয়ে রওনা দিচ্ছে ঠিক তখনই এ ব্যক্তির বাথরুম চাপবে। এসব নিয়ে কিছু বলাও যায় না। বাথরুম মৌলিক অধিকার, কার কখন মুড আসে ঠিক নেই। আমার এক বন্ধু ছিল এমন। সবাই বের হবে এই সময় সে বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিত। ভেতর থেকে ভেসে আসত রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমি একদিন ঝাড়ি দেওয়ার পর বলে, ঠিক যখন সে বুঝতে পারে আগামী কয়েক ঘন্টা আর বাথরুমে যাওয়া যাবে না তখনই তার মুড আসে। এরকম টাট্টি বালকেরা সবাইকে আধাঘণ্টা দেরি করিয়ে দিয়ে আবার আধাঘণ্টা যাবার পরেই 'মুতপো মুতপো' বলে হৈ-হল্লা লাগিয়ে দেয়!
৩#
এ ধরণের লোকের কাজ হচ্ছে সবাই ডাইনে গেলে তার বামে যাওয়া। এরা নিষ্ঠার সাথে ভ্রমণে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করে থাকে। সবাই ম্যাকডোনাল্ডসে খেতে গেলে সে বলে আমি সাবওয়ে খাব। সবাই পাহাড়ে উঠতে চাইলে এ বলে আমি নদীতে নামব। সবাই যখন আড্ডা দিবে এ তখন ঘুমাবে আর সবাই ঘুমাতে গেলে এ টিভি দেখতে বসবে।
৪#
কিছু মানুষের জন্মই হয় শেষ মুহূর্তে দৌড়ানোর জন্য। এর রেডি হতে দুই ঘন্টা লাগবে। সকালে উঠে শ্যাম্পু করবে, তার উপর কন্ডিশনার দিয়ে আবার জেল লাগাবে। তার পর আবার আধাঘণ্টা চিরুনি নিয়ে যুদ্ধ করবে। কী পরবে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চার-পাঁচবার জামা বদল করবে। সবশেষে যখন 'অলমোস্ট রেডি' বলে হাঁক দিবে তখন বুঝা যাবে আরও এক ঘন্টা মিনিমাম।
৫#
এমন ভ্রমণসঙ্গীরা কথায় কথায় গাল ফুলায়। ভ্রমণের বড় সময় চলে যায় 'ও লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা' বলে তার রাগ ভাঙাতে। ইমোশনাল লাউ বালকের শানে-নজুল বলি। ছোকরা কথায় কথায় গাল ফুলায়। একবার সবজির দোকানে গিয়ে লাউ হাতে রুমমেটকে কী জানি জিজ্ঞেস করল। রুমমেট কী জানি একটা মশকরা করে ছোকরার কী জানি একটা অনুভূতিতে আঘাত দিল। রাগ করে লাউ হাতে হাঁটা দিল। দোকান থেকে বাসা তিন চার মাইল দূরে। গাল ফুলিয়ে লাউ হাতে পুরা তিন চার মাইল হেঁটে বাসায় চলে আসল। এরপর থেকে কেউ রাগ করলেই তার হাতে লাউ কুমড়া কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে বলি- যা হাঁটা দে।
৬#
এমন ভ্রমণসঙ্গীরা বদমেজাজি। ভ্রমণের দুই দিন যেতে না যেতেই যাত্রাপথের ধকলে তার মেজাজ ফরটি নাইন হয়ে যায়। কারণে অকারণে বাকিদের উপর চেঁচামেচি শুরু করে। এদের রাগ দ্রুত পড়ে যায়, তবে সবাই আতঙ্কে থাকে আবার কখন ক্ষেপে যাবে- এই চিন্তায়।
৭#
এরা নেতা গোছের। কেউ না দিলেও সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। প্রতিদিন সকালে ঠেলে সবার ঘুম ভাঙায়। কই যেতে হবে, কী করতে হবে, কী খেতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়। এরা আর্মি গোত্রীয়। শুরুতে এদের ডিসিপ্লিন ভালই লাগে কিন্তু কয়দিন পরেই গণতন্ত্রের জন্য পরাণ হাঁসফাঁস করে।
৮#
বিবাহিত লোক মাত্রই জানেন আপনি আহ্লাদ করতে গেলে আপনার স্ত্রী যদি মুখ কুঁচকে আপনাকে বলে মাথা ধরেছে তার মানে 'ডাল ম্যায় কুচ কালা হ্যায়'। নিশ্চিত জানবেন সেই মাথাধরার কারণ আপনি। ভ্রমণেই এইরকম কিছু মুখ কুঁচকানো মাথাধরা বয় বা গার্ল দেখা যায়। আমরা সব বন্ধু মিলে একবার সমুদ্রে বেড়াতে গেলাম। সৈকতের পাশে বাড়ি, সেখানে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। দিনের বেলা ঘুরেটুরে রাতে সবাই মিলে রান্না করতাম। তখন একজনের রাতকানা রোগ হল। সারাদিন ভাল, রাত হলেই তার গা ম্যাজম্যাজ করে, মাথাব্যথা করে, মরণাপন্ন অবস্থা হয়। পরে বুঝলাম যেন কোনো কামকাজ না করতে হয় সেজন্য শালা ভাব ধরেছে। সবাই মিলে রান্নাবান্না করত আর সেই ব্যাটা দুই তিন থালা খেয়ে ঘুম দিত। সকালে উঠে দিব্যি চাঙ্গা। এরকম মাথাধরা রোগী কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে বা ভাব ধরে পুরো ভ্রমণ জুড়ে বাংলার পাঁচের মত চেহারা করে বসে থাকবে।
৯#
শিশুদের কোলে নিয়ে একটু দোলা দিলে তারা দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ে। কিছু কিছু বড় মানুষও আছে একটু গাড়ি, প্লেন বা নৌকা যেকোনো কিছুর একটু দুলুনিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। এরা বিশাল এনার্জি নিয়ে 'ইয়াহু ঘুরতে যাচ্ছি' বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে ভ্রমণ শুরু করে। তারপর গাড়িতে উঠেই ঘুম। ঢুলতে ঢুলতে আধো ঘুম আধো জাগরণে শেষ হয় এদের ভ্রমণ। আমার এক বন্ধু এমন আম্রিকার রকি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, আটলান্টিক, প্যাসিফিক, ডিজনি-ফিজনি সব দেখে ফেলেছে ঘুমাতে ঘুমাতে। ওইগুলা দেখতে কেমন জিজ্ঞেস করলে হাঁ করে থাকে।
১০#
ভ্রমণে মল পরিত্যাগ করা শ্রেয়। এই মল সেই মল না। মল মানে শপিংমল। আমেরিকার নিউইয়র্কের দোকানে যা পাওয়া যায়, আলাবামার দোকানে প্রায় একই জিনিস পাওয়া যায়। তারপরেও দ্য মল গার্ল সাথে থাকলে সামনে পাওয়া গিফট শপ, শপিংমল সবখানে একবার ঢুঁ মারতে মারতে আপনার ঘোরার আনন্দটাই মাটি করবে। এইটা দেখবে, সেইটা হাতাবে তারপর দুই ঘন্টা খরচ করে দুই টাকা দামের একটা ফ্রিজ ম্যাগনেট কিনে পরের দোকানে গিয়ে ঢুকবে।
১১#
এরা গাদা বন্দুক সাইজের ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে। সাথে কাঁধে একটা ট্রাইপড। রাস্তায় কাক, চিল, শকুন যাই দেখুক না কেন 'ও আল্লা কী বিউটি' বলে ট্রাইপড গাঁথা শুরু করে। বিশাল যত্নআত্তি করে ছবি তোলার পর ছবি দেখে- 'বোধ হয় বাঁদরের হাতে খুন্তি দেয়া কক্ষনো উচিত নয়'।
১২#
এরা পুরা পথে তার স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে খুটমুট করে যাবে। 'গোয়িং ফর ভেকেশন, ইয়াহু' বলে স্ট্যাটাস মেরে তারপর প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট দিবে 'আমি এখন এইখানে'। রাতে যেই হোটেলে থাকবে তার কমোড থেকে শুরু করে সব কিছুর ছবি তুলে আপলোড করে দিবে। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে তার ছবি আপলোড করবে। গন্তব্যে পৌঁছে, 'সুন্দরবন, হেয়ার আই কাম' বলে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দিবে। স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পুরা ভ্রমণ শেষ হয়ে যাবে, চর্মচক্ষু দিয়ে কিছু দেখা হবে না।
(লেখকের 'এসো নিজে করি' বই থেকে সংক্ষেপিত)
অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির