পৃথিবীর যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কোনো একটি নতুন সরকার দায়িত্ব নেবার পর মাসতিনেক একে সময় দেয়া হয়; প্রয়োজনীয় স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্টের জন্য। এরপর নাগরিক সমাজের দায়িত্ব দাঁড়ায় সরকারটিকে জবাবদিহিতায় বাধ্য করার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে পৃথিবীর সভ্য কল্যাণরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত তুলে ধরার খুব প্রয়োজন নেই। উনি তাঁর এক্সপোজারের কারণে জানেন, সিভিল সোসাইটি কতটা ক্রিটিক্যাল হতে পারে; আর সরকারকে কত সহনশীলতার সঙ্গে সেসব সমালোচনা মেনে নিতে হয়।
ঐ যে আওয়ামী লীগের পশ্চাদপদ চিন্তার সাবেক সরকারটি এই নাগরিক সমাজের সমালোচনার প্রতি হিংস্র হয়ে গণধিকৃত হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আওয়ামী লীগের জমিদারি হারানো অনুতাপহীন প্রতিহিংসাপরায়ণ সমর্থকদের অযৌক্তিক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতিতে দিশেহারা ভারতের গদি মিডিয়ার অশালীন ডিফেমেশন শুনতে হয়েছে। এসব আওয়ামী ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তার মানে সাড়ে পনেরো বছরের আওয়ামী ফ্যাসিজমে সাধারণ মানুষ; যা কিছু আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্য তাকেই অপছন্দ করতে শুরু করেছে। কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাঝে আওয়ামী লীগের কোন বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হলে; তা সর্ব সাধারণের মাঝে সমালোচিত হবে।
সাবেক ব্যর্থ শাসক শেখ হাসিনার বৈশিষ্ট্য ছিল, নিজ জেলা গোপালগঞ্জের লোক দিয়ে ক্ষমতা-কাঠামো সাজানো। এই আঞ্চলিকতা একটি গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও এরকম গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হয়েছে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে কেবল যোগ্য লোকগুলো ড ইউনুসের গ্রাম চট্টগ্রামে জন্মেছে; তা তো নয়। আর হিন্দুদের দেবতা গণেশের মতো ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে যার মুখ প্রথম চোখে পড়বে; তার মাথাটা নিজ দেহে স্থাপন করতে হবে এমন তো নয়। চট্টগ্রামের হাতির মাথাটি সরকারের মাঝে একটি গণেশ কিংবদন্তী রচনা করেছে। এটি সংশোধন করতে হবে।
ব্রিগেডিয়ার ড সাখাওয়াতের মতো যোগ্য প্রশাসককে সাতদিনের মাথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া; অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ভুল। বাংলাদেশের ভাগ্যে কেন একজন সুদর্শন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, খ্যাতিমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জুটেও জুটে না; তা বুঝতে পারি না; একি গ্রিক ট্র্যাজেডির হুব্রিশ। ফলে দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি একটি ভঙ্গুর জায়গায় রয়ে গেলো।
বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কেন আওয়ামী লীগের জায়গায় জামায়াত আদর্শের লোক পদায়িত হলো অনেকগুলো ক্ষেত্রে তা বোধগম্য নয়। আওয়ামী কালচারের হিন্দুত্ববাদী সমস্যা আর জামায়াত কালচারের ইসলামপন্থী সমস্যা আসলে একই সমস্যা। প্রতিষ্ঠান কখনো গোত্রীয় বা ট্রাইবাল কালচারে গড়ে উঠতে পারে না; একে হতে হবে বহুত্ববাদী। সিভিল প্রশাসনে আওয়ামী লীগের হিন্দুত্ববাদী কর্মকর্তায় আস্থা রাখা আর অন্যদের ইসলামপন্থী কর্মকর্তায় আস্থায় রাখা একে ক্রমেই ভঙ্গুর, আনস্মার্ট ও যুগের অনুপোযোগী করেছে। বিসিএস মেধা তালিকার ভিত্তিতে পদায়ন হলে এই বিভ্রাটটি প্রশাসনে তৈরি হতো না।
সেনাবাহিনী ট্র্যাডিশনালি নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান ছিলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেনারেল তারেক সিদ্দিকির মাধ্যমে মেধাবী কর্মকর্তার পরিবর্তে অনুগত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের আভিজাত্যহানি করা হয়েছে। অনভিজাত মানুষ মানেই সামান্য প্রাপ্তির লোভে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া। সেনাবাহিনীকে এই আনসফিস্টিকেটেড তারেক সিদ্দিকি ভাইরাস মুক্ত করার কাজটি কতটুকু হয়েছে; তা মূল্যায়ন করা জরুরি।
মওদুদ আহমেদ বসন্তের কোকিল রাশির লোক, যিনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সব আমলে দুধের মাছি হয়ে ক্ষমতার বাটিতে বসেছেন। এই প্রজন্মের অনেক মওদুদ আহমেদকে পনেরো বছর আওয়ামী লীগকে তেলাঞ্জলি দিয়ে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের টুপি পরে বিভিন্ন পদে বসে পড়তে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতা-কাঠামোতে দুই ধরনের লোক ক্ষতিকর। এক, যারা গাছেরটাও খান, তলারটাও কুড়ান। দুই, যারা জুলাই বিপ্লব করেছি বলে দ্রুত বিপ্লবের সুফল কুড়াতে চান। এইসব দরিদ্র মন কখনোই উদার জনপ্রশাসন তৈরি করতে পারে না।
জুলাই জাগরণ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জনমানুষের ঐক্য সূচিত করেছে। কাজেই জুলাই অভ্যুত্থানে রক্ত-ত্যাগের মাঝ দিয়ে যে তরুণেরা বাংলাদেশকে হাসিনা রাহু মুক্ত করেছে; তাদের প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতা কম হলেও; তারা আন্তরিকতা দিয়ে সে সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম।
কিন্তু জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিলো না; পনেরো বছর হাসিনার অপশাসনের ব্যাপারে উদাসীন থেকে ‘দাদা আমি সাথে পাঁচে থাকি না’ মার্কা লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখায়; এরা বিপ্লবের স্পিরিট কতটা ধারণ করতে সক্ষম; তা জানি না; আর এরা তেমন কোন ঈশান স্কলার নন যে জীবনে বিরাট কোন ছাপ রেখেছেন কোন একটি ক্ষেত্রে। যে কারণে তিনমাসে কোন একটি ক্ষেত্রে নক্ষত্রের আলো দেখিনি আমরা।
পৃথিবীর সভ্য সমাজগুলোতে দেখা যায়, একজন গবেষক, বিজ্ঞানী, লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সংস্কৃতিজন, উদ্যোক্তা নিজের কাজের মধ্যে এতো আনন্দ পান যে; তাদেরকে ক্রেন দিয়ে টেনেও কোন সরকারি দায়িত্বে আনা যায়না। আর আমাদের এমন এক বুভুক্ষু গরিব মনের সমাজ যে; একটা পতাকা ওড়ানো গাড়ি; তোয়ালে ঢাকা চেয়ার, সরকারি গৃহ, আর প্রাগৈতিহাসিক কালের চাকর-বাকর-আর্দালি-মালি-ব্যাট ম্যান, কিছু বিদেশ সফর, কিছু সুশাসন বঞ্চিত হতভাগ্য মানুষ স্যার স্যার করে পেছনে পেছনে ঘোরা; এইসব খেলনা জীবন উপভোগের লোভে লোকজন মুখে বিপ্লব, পরিবর্তনের গাল-গল্প আর পকেটে সিভি নিয়ে ঘুরে; এরা ‘শেফালির ঝুড়িতে আগুন চেপে ঘুরে বেড়ায়’।
ফলে কল্যাণরাষ্ট্র তৈরির কাজটি করার উপযুক্ত লোক খুঁজে পাওয়া যায়না আমাদের সমাজে। প্রতিটি দপ্তরের বোর্ডে এ যাবত দায়িত্বপ্রাপ্তদের তালিকাটি একদল ব্যর্থ মানুষের তালিকা হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ আমলে জনগণ সমালোচনা করলে গাজিপুরের করাত কলের বালকটি চুলে জেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কাজ পেয়ে ফেসবুকে এসে লিখতো, কি হিংসে হয়! আমরা আশা করি এই দরিদ্র মানস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কারো মন মানচিত্রে ফুটে উঠবে না।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা মানে আসলে পাবলিকের পাঞ্চিং ব্যাগ হয়ে বেঁচে থাকা। খ্যাতিমান লেখক ও টকশো আলোচক হিসেবে সেলিব্রেটি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রথম তিনমাসে সবচেয়ে সমালোচিত হয়েছেন। উনি গুড হিউমারে নিয়েছেন সব জনসমালোচনা। আমার ধারণা আসিফ নজরুল এবার খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার হিসেবে পরিচিত মোস্তফা সরওয়ার ফারুকিকে উপদেষ্টা হিসেবে এনে দিয়েছেন; যাও এবার তার আওয়ামী লীগ আমলের ফেসবুক স্ট্যাটাস খুঁজে বের করো; আর স্বাস্থ্যপান করো। এমন পাঞ্চিং ব্যাগটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন