যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে- বঙ্গদেশীয় নারী সম্বন্ধে আমাদের কথাবার্তাগুলো কেনো যেনো শুধু এই দুয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু দুনিয়ার সব নারী এমন চিন্তায় আবদ্ধ হয়ে ছিলেন না। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের সাথে জড়িয়ে আছে নারীদের নাম। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে এমনই ১১ টি আবিস্কারের গল্প থাকছে eআরকি পাঠকদের জন্য।
১# মনোপলি
ছোটবেলায় ‘ধনী হবার মজার খেলা’ বা মনোপলি খেলেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। আপনি জানেন কি মনোপলি খেলাটি আবিষ্কার করেছিলেন একজন নারী? ১৯০৪ সালে এলিজাবেথ ম্যাগী নামের জনৈকা মার্কিন নারী পুজিবাদকে কটাক্ষ করে তৈরী করেন ‘The Landlord’s Game’, যা পরবর্তীতে মনোপলি নামে পরিচিত হয়।
২# আধুনিক রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ
নিত্যদিনের সঙ্গী আধুনিক ফ্রিজ কিন্তু একজন মেয়েরই আবিষ্কার। ১৯১৪ সালে মার্কিন তরুণী ফ্লোরেন্স পারপার্ট আবিষ্কার করেন আধুনিক বৈদ্যুতিক ফ্রিজ। বিদুষী এই নারী আরও আবিষ্কার করেন রাস্তা পরিষ্কার করার যন্ত্র, যা তিনি নিজেই পুরো আমেরিকায় বিক্রি করেছেন।
৩# আইসক্রিম বানানোর যন্ত্র
‘মালাই, মালাই, কুলফি মালাই!’ অথবা আইসক্রিম কার না ভালো লাগে? আর এই বাসাবাড়িতে আইসক্রিম বানানো যন্ত্র আবিষ্কারের পেটেন্ট একজন নারীর। ১৮৪৩ সালে আমেরিকার ন্যান্সি জনসন আবিষ্কার করেন এই যন্ত্র।
৪. সিসিটিভি
Closed Circuit Television বা CCTV আজকের দিনে খুব পরিচিত একটি শব্দ। এই সিসিটিভির আবিষ্কার হয়েছিলো আফ্রিকান-আমেরিকান ম্যারি ভ্যান ব্রিত্তান ব্রাউন এর হাতে ১৯৬৯ সালে। দুনিয়ার তাবৎ অপরাধীরা নারী বিদ্বেষী হতেই পারেন, কারণ এ আবিষ্কারের পরে অপরাধীর পরিচয় সনাক্তকরণ হয়ে গেছে অনেক সহজ।
৫# কেভলার ফাইবার
নামটা খটোমটো শোনালেও আমরা নিত্য এই বস্তুর ব্যবহার শুনে থাকি। কেভলার নামক তন্তু থেকেই তৈরি হয় আধুনিক বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। এই তন্তু ইস্পাত থেকে ৫ গুন বেশী শক্তিশালী। কেভলার আবিষ্কার করেন মার্কিন রসায়নবিদ স্টেফানি কোলেক।
৬# কম্পিউটার সফটওয়্যার
পৃথিবীর সর্বপ্রথম ব্যানিজিক কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডঃ গ্রেস মারে হুপার। তিনিই সর্বপ্রথম সফটওয়্যার এর প্রোগ্রামিং ভুলকে ‘বাগ’ নামে সম্বোধন করেন। মজার বিষয়, তিনি একই সাথে নেভীর একজন রিয়ার এডমিরালও ছিলেন।
৭# মেডিক্যাল সিরিঞ্জ
চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বস্তু হচ্ছে সিরিঞ্জ। ১৮৯৯ সালে লেটিশা মামফোর্ড গিয়ার এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন সিরিঞ্জ আবিষ্কার করেন। যা থেকে আজকের দিনের আধুনিক সিরিঞ্জের সূচনা হয়।
৮# ফায়ারস্কেপ অথবা অগ্নিতারন পথ
অগ্নি সংযোগের ঘটনা থেকে বাঁচতে যুগান্তকারী এই ব্যবস্থাটি আবিষ্কার করেন আনা কনেলি, ১৮৮৭ সালে।
৯# কল ওয়েটিং প্রযুক্তি ও কলার আইডি
কল ওয়েটিং প্রযুক্তি ও কলার আইডির মত অত্যন্ত কার্যকারী প্রযুক্তি আবিষ্কারের পেছনের মূল কারিগর একজন নারী। মার্কিন পদার্থবিদ শার্লি অ্যান জ্যাকসন ১৯৭০ সালের দিকে কিছু গবেষণা করেন যার ফলশ্রুতিতে আবিষ্কৃত হয় কল ওয়েটিং এর মত কার্যকারী প্রযুক্তি।
১০# উইন্ডস্ক্রিন ওয়াইপার
বৃষ্টির দিনে একটু পর পর গাড়ির গ্লাসের পানি না সরালে শয়ে শয়ে দুর্ঘটনা হত প্রতিদিন। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের এই উইন্ডস্ক্রিন ওয়াইপার আবিষ্কার করেছেন আমেরিকার মেরি এন্ডারসন, ১৯০৩ সালে। যদিও তখন এই আবিষ্কার গাড়ি কোম্পানিগুলো খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি, তাদের অভিযোগ ছিলো এগুলো চালকের মনোযোগ সরিয়ে দিবে। এখন উইন্ডস্ক্রিন ওয়াইপার ছাড়া গাড়ি কল্পনা করেই দেখুননা!
১১# ডিশ ওয়াশার
ভাবুনতো, খাবার পরে একটু আমোদ করবেন, একটু শুয়ে আরাম করবেন, তা না করেই আপনাকে ছুটতে হচ্ছে থালাবাটি ধুতে। এমন আমোদ প্রিয় মানূষের জন্য ডিশ ও্যাশার বা সয়ংক্রিয় থালা বাটি ধোয়ার যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন জোসেফিন কশরেইন, ১৮৮৭ সালে।
১২# লাইফ র্যাফট
উত্তাল সাগরে জাহাজে দিন যাপন করা মানুষজন একজন নারীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে পারেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে মারিয়া বেজলি নামের এক আমেরিকান উদ্ভাবক, যিনি কিনা আবিষ্কারের দুনিয়ায় আসার আগে ছিলেন একজন দর্জি, আধুনিক লাইফ র্যাফট উদ্ভাবন করেন। আগের জামানায় লাইফ র্যাফট ছিল কাঠের তক্তা। ১৮৮২ সালে উদ্ভাবিত আধুনিক লাইফ র্যাফটের কল্যাণেই ১৯১২ সালের টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পরেও বেঁচে গিয়েছিলেন ৭০৬ জন যাত্রী। আধুনিক লাইফ র্যাফট ছাড়াও মারিয়ার দীর্ঘ উদ্ভাবনের তালিকায় আছে কুকিং প্যান, ফুট ওয়ার্মার, ট্রেনকে লাইনচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এন্টি-ডিরেলমেন্ট ডিভাইসের মতো দরকারি সব জিনিস।
১৩# ওয়্যারলেস ট্রান্সমিশন প্রযুক্তি
অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান অভিনেত্রী হেডি ল্যামারের শুরুর জীবনটা বেশ উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থাতেই কেটেছে। ইউরোপে বিতর্কিত সময় পার করে তিনি পারি জমান হলিউডে। ত্রিশ-চল্লিশের দশকে হেডি ল্যামার ছিলেন হলিউডের বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। অভিনয়ের পাশাপাশি আবিষ্কারের নেশাও ছিল পুরোদমে। একাধিক ‘ফ্লপ’ আবিষ্কারের পর অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে হেডি জানতে পারেন রেডিও কন্ট্রোলড টর্পেডো নিয়ে। তিনি দেখেন যে, এসব টর্পেডোর সিগন্যালে খুব সহজেই জ্যাম লাগিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা যায়। তখন হেডি তার এক পিয়ানোবাদক বন্ধু জর্জ অ্যান্থেইলকে সাথে নিয়ে আবিষ্কার করলেন ফ্রিকোয়েন্সি হপিং সিস্টেম। এর মাধ্যমে পাঠানো ফ্রিকোয়েন্সি সব জ্যামকে লাফিয়ে পার করে ফেলতে পারবে। তখনই আমেরিকানরা এটিকে ব্যবহার করতে না পারলেও পরবর্তী সময়ে টর্পেডো ও মিসাইলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এবং আজকের যে ওয়াইফাই ছাড়া আমাদের জীবন চলে না, সেটিরও উদ্ভব কিন্তু হেডি ল্যামারের সেই আবিষ্কার থেকেই।
১৪# সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম
নারীরা যে শুধুমাত্র রেফ্রিজারেটর কিংবা কুলফি মালাইয়ের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল তেমনটাই না, একজন নারী আবিষ্কার করেছিলেন শীতের দিনে উত্তপ্ত থাকার সহজ ব্যবস্থা। আফ্রিকান-আমেরিকান উদ্ভাবক এলিস পার্কার ১৯১৯ সালে ডিজাইন করেছিলেন গ্যাস-চালিত সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম। পুরনো ফায়ারপ্লেসে কাঠ কয়লা পুড়িয়ে তাপ উৎপাদন করা হতো। তার চেয়ে এই আবিষ্কার অনেক নিরাপদ ছিল। যদিও সেই সময়ে খুব বেশি প্রচলিত হয়নি এই আবিষ্কার। তবে শীতের দেশগুলোয় আজকে যে সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম দেখা যায়, সেটির সূচনার কৃতিত্ব এলিস পার্কারকেই দিতে হবে।
১৫# কার হিটার
শীতপ্রধান দেশগুলোয় কেউ যখনই কোনো গাড়িতে উঠে তখন একজন ব্যাক্তিকে তারা ধন্যবাদ দিতেই পারে। মার্গারেট উইলকক্স আবিষ্কার করেছিলেন গাড়ির হিটিং সিস্টেম। তার সময়ের কয়েকজন নারী প্রকৌশলীদের মধ্যে অন্যতম মার্গারেট এমন একটা সিস্টেম তৈরি করেছিলেন যা ইঞ্জিন থেকে উৎপন্ন হওয়া তাপ গাড়ির ভেতরে নিয়ে এসে ভেতরকে উষ্ণ করতে পারে। ১৮৯৩ সালে কার হিটিং সিস্টেমের আবিষ্কারের পর থেকে এটি গাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।
১৬# চকোলেট চিপস
চকোলেট চিপস খেয়েছেন অথচ পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন। এই সুস্বাদু স্ন্যাকসের উদ্ভাবন হয়েছিল ভুলক্রমে। অতিথিদের জন্য বাটার কুকি বানাতে গিয়ে ভুল করে রুথ ওয়েকফিল্ড চকলেট চিপস বানিয়ে ফেলেন। ১৯৩৮ সালে আবিষ্কারের পর থেকে আজ পর্যন্ত চকোলেট চিপসের জনপ্রিয়তা কখনো পড়েনি।
১৭# ইনভিজিবল গ্লাস
ক্যাথরিন বার ব্লোগেট ছিলেন একজন মেধাবী কেমিস্ট। তিনি অদৃশ্য কাচ আবিষ্কার করেন। কাচের দুই পাশে এমন একটা লেয়ার যুক্ত করেন যাতে কাঁচ থেকে প্রতিফলিত দৃশ্যমান আলো ওই লেয়ার থেকে প্রতিফলিত আলোকে নাকচ করে দেয়। বর্তমানে কম্পিউটার পর্দা, উইন্ডশিল্ড, মুভি ক্যামেরায় এ প্রযুক্তি ব্যাবহৃত হয়।
১৮# রিট্র্যাক্টেবল ডগ লিশ
আপনি আপনার পোষা কুকুর নিয়ে বের হয়েছেন, তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে করতে হাপিয়ে যাচ্ছেন। গলায় দড়ি পড়ানো থাকা সত্ত্বেও এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আপনাকে নিয়ে। এমন অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে ১৯০৮ সালে ম্যারি ডেলানে একটি যন্ত্রের আবিষ্কার করেন। যেটা দিয়ে কুকুর দড়ি সহ অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতে পারবে। আপনি সুইচ টিপে দিলে সূতা আপনা আপনি পেচিয়ে কুকুরকে আপনার কাছে নিয়ে আসবে।
১৯# সার্কুলার স বা ঘূর্ণায়মান করাত
আশেপাশের পুরুষদের কষ্ট করে করাত দিয়ে কাঠ কাটতে দেখে তাবিথা ব্যাবিট সার্কুলার করাতের একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন। সার্কুলার স’’ কিংবা ঘূর্ণায়মান করাত দিয়ে খুব সহজেই কাঠ কাটা যায়। বর্তমানে বানিজ্যিক ভাবে তার বানানো প্রোটোটাইপের আধুনিক সংস্করণ ব্যাবহৃত হচ্ছে
২০# অ্যালফাবেট ব্লক
আমরা সবাই আলফাবেট ব্লকের সাথে পরিচিত। ছোটবেলায় অনেকেরই বিভিন্ন বর্ণের সাথে পরিচয় হয়েছে আলফাবেট ব্লক দিয়ে খেলতে খেলতে। ম্যাসাচুসেটসের এক কবি ও লেখক ডি. টি. হুইটনি এটি আবিষ্কার করেন।
২১# ফ্ল্যাট বটমড পেপার ব্যাগস বা ঠোঙা বানাবার মেশিন
১৮৬৮ সালে একটি কাগজের ব্যাগের কারখানায় কাজ করার সময় মার্গারেট নাইটহুড এমন একটি যন্ত্রের কথা ভাবেন যেটি কাগজ ভাজ করে গ্লু লাগিয়ে জোড়া দিতে পারবে। এই যন্ত্র ব্যাবহার করে ব্যাগের নিচের অংশ সমতল করে বানানো যায়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত যন্ত্রটি ব্যাবহৃত হয়ে আসছে।