হুমায়ূন আহমেদের চোখে খাদ্যবিলাস!

১৪৩১৮ পঠিত ... ২২:১২, নভেম্বর ১৩, ২০১৯

যদি বলি বাঙালির খাদ্য এবং গদ্য রুচির ভিন্নতা আনয়নে হুমায়ুন আহমেদের বিশেষ অবদান আছে, তবে অনেকেই হৈহৈ করে উঠবেন। তবে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে এক চামচ ঘি, মচমচে বেগুন ভাজা, সবুজ কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে বাসি পোলাওয়ের সাথে ডিম ভাজা-- এই সামান্য খাবারকে বাঙালির কাছে অসামান্য করে তুলেছেন যিনি, তাকে কিন্তু খাদ্যরসিক হিসেবে সেভাবে আমরা মনে রাখিনি। চলুন আজ eআরকি করতে করতেই আলোচনা করা যাক হুমায়ূন সাহিত্যে খাদ্যপ্রীতির কথা। 

আতাহারকে মনে আছে? ‘কবি’তে সে তার বন্ধু সাজ্জাদের বোন নীতুকে যতটা ভালোবেসেছিল, হয়তো তার থেকেও বেশি ভালোবেসেছিল নীতুর হাতের নাশতাকে। আহামরি কিছু নয় সে নাশতা... এই একটু আগুন-গরম পরোটা, ডিমভাজা আর গরুর মাংস। মচমচে সেই পরোটা একটা খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই চলে আসবে দ্বিতীয়টা, দ্বিতীয়টা শেষে তৃতীয়টা। খাওয়া শেষে এক কাপ চা বা কফি। 

মনে নেই? তাহলে তো মনে হচ্ছে আতাহারের বাবাও আপনার থেকে বেশি ভোজন রসিক ছিলেন। উনি অন্তত বাসর রাতে স্ত্রীর হাতে এক গ্লাস লেবুর শরবত খেতে চাওয়ার মতো সাহসী কাজ করেছেন। 

কবির কথা থাক। 'লীলাবতী'তে লীলার জন্য আয়োজন করে তাঁর মায়ের রান্না কাঁঠালের বিচির সাথে মুরগির সালুনের কথা মনে আছে? আহা, মুরগির মাংসের সাথে কাঁঠালের বিচি, স্বাদ তো অপূর্বই হওয়ার কথা। মুরগির মাংসের সাথে যে কাঁঠালের বিচির চমৎকার রসায়নের কথা হুমায়ূন ছাড়া এই শহুরে প্রজন্মকে কেই-বা জানিয়েছে!  

তেঁতুল বনে জোছনার কথা মনে আছে, যেখানে ডাক্তার আনিসকে মতি বেশি করে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে ঝালঝাল করে মরা ডাহুক পাখি রান্না করে খাওয়াতে চায়? হুমায়ূন ভাষ্যে ডাহুক অন্য পাখির মত শক্ত নয়, এর মাংস নাকি অত্যন্ত মোলায়েম।

জোছনা ও জননীর গল্পে যুদ্ধের দিনগুলোতে বিয়ে আর এরপর খুব একচোট প্রেম করেছিল নাইমুল আর মরিয়ম। নাইমুলের পছন্দ একদম চিকন করে কাটা আলু ভাজি। সাথে কাঁচা টমেটো পুড়িয়ে ভর্তা। মরিয়ম নিজে রান্না করেছে নতুন আলু দিয়ে মুরগির মাংসের ঝোল।  

'মাতাল হাওয়া'য় পাওয়া যায় কালিজিরার চালের ভাতের সাথে মুরগির মাংসের মুখরোচক স্বাদের মন উতলা করা বর্ণনা। আর ‘মধ্যাহ্ন ২’তেও আছে কালিজিরার চালের ভাত, সাথে খাসির মাংস, পেঁয়াজ। তবে তখনও পেঁয়াজের কেজি একশো ত্রিশ টাকা ছিল কিনা তা তিনি লিখে দিয়ে যাননি! 

‘মধ্যাহ্ন ২’ উপন্যাসে তিনি দিয়েছেন আরও কিছু অপূর্ব কিছু খাবারের বর্ণনা--

‘শরিফা অতি দ্রুত খাওয়ার ব্যবস্থা করল। গরম ভাত। খলিসা মাছের ঝোল, পাট শাক, ডাল।’

‘মাওলানা খেতে বসেছেন। শরিফা সামনে বসে গরম ভাতে পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। আজকের আয়োজন ভালো। করিমের পছন্দের পাবদা মাছ। হাওরের লাল মুখো বড় পাবদা। ঝোল ঝোল করে রান্না। শরিফা পাতের কোণায় আদা সরিষা বাটা দিয়ে রেখেছে। তরকারির সাথে এই জিনিস মিশিয়ে খেতে খুবই ভালো লাগছে।’

‘পিতা ও কন্যা দুজনকেই খাবার দেয়া হয়েছে। অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ভর্তি ভাত। ভাতের উপর গাওয়া ঘি। একপাশে ডিমের সালুন। আলাদা বাটিতে ডাল। ঘিয়ের গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে।’

‘সবুজ কলাপাতায় ধবধবে সাদা ধোঁয়া উঠা গরম ভাত। ঝিঙ্গা দিয়ে রাঁধা লাবড়া, সঙ্গে মাছের ঝোল। খেতে খেতে লাবুসের মনে হলো, জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ ভরপেট খাওয়ায়। এইজন্যেই হয়তো বেহেশতে খাওয়া-খাদ্যের বর্ণনায় এতো জোর দেয়া হয়েছে।’ 

‘হেমন্তে নতুন ধান খেয়ে হাঁসের গায়ে চর্বি হয়, সেই হাঁস নতুন আলু দিয়ে ভুনা করে শীতের সকালে চালের রুটি দিয়ে খাওয়ায় যে কী স্বাদ।’ আহা, একজন আদর্শ খাদ্যপ্রেমিকের কাছে ‘এবং হিমু’ পড়াটা সার্থক হয় এই এক লাইনেই!  

'সে আসে ধীরে' উপন্যাসে কাঁচামরিচ, সরিষার তেল, পিয়াজ দিয়ে মাখানো চালভাজাকে বেহেশতি কোন খানা হিসেবে বর্ণনা করেছেন হুমায়ূন। মিসির আলীর 'নিষাদ'-এ আমরা পাই 'মিসির মিকচার' নামে জিভে জল আনা এক রেসিপি-- 'নতুন ধরনের রান্না। আমিই তার আবিষ্কারক। নাম হচ্ছে মিসির মিকচার। চাল, ডাল এবং আলু একসঙ্গে মিশিয়ে দু চামচ ভিনিগার, এক চামচ সয়া সস, একটুখানি লবণ, দুটো কাঁচা লঙ্কা এবং আধা চামচ সরিষা বাটা দিয়ে সেদ্ধ করতে হয়। সেদ্ধ হয়ে যাবার পর এক চামচ বাটারওয়েল দিয়ে দমে দিতে হয়-অপূর্ব একটা জিনিস নামে। খেয়ে দেখ।'

'মিসির আলীর চশমা' চোখে দিয়ে তিনি রেসিপি দিয়েছেন এক অদ্ভুত ইলিশ মাছ রান্নার-- 'ইস্ত্রি ইলিশ: ইলিশ মাছ সর্ষে বাটা, কাঁচামরিচ এবং লবণ দেয়ার পর লাউপাতা দিয়ে মুড়তে হবে। তারপর গরম ইস্ত্রির নিচে বসিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর মাছ উল্টে আবার ইস্ত্রি চাপা দেয়া।' এই রেসিপি কেউ ট্রাই করেছে কিনা এখনো পর্যন্ত না জানা গেলেও 'মিসির আলী! আপনি কোথায়?' বইয়ে জানা গেলো কৈ মাছেরও নাকি ভর্তা হয়। তাও আবার যেই সেই ভর্তা না, কৈ মাছের ভর্তার পাশে নাকি অন্য ভর্তা দাঁড়াতেই পারবে না। 

'পুফি' পড়তে গিয়ে আমরা পাই টোস্ট বিস্কিটের সাথে পনির খাওয়ার এক নতুন উপায়-- 'পনিরের ওপর এক ফোঁটা রসুনের রস। গার্লিক টোস্ট উইথ চিজ।’ এদিকে 'মিসির আলী UNSOLVED'-এ আমরা পাই আরেক আইটেম, ‘আজ সে রাঁধবে কলার মোচা এবং চিংড়ি দিয়ে এক ধরনের ভাজি। কাঁচামরিচ এবং পেঁয়াজের রস দিয়ে মুরগী।’ তবে 'এবং হিমু' উপন্যাসে যে বর্ণনা পাই আলু ভাজার সেটার তুলনা নাই-- 'চাক চাক করে কাটা আলু ঘিয়ে ভেজে তার সাথে ভাজা শুকনা মরিচ মাখিয়ে ভাতের সাথে খাওয়া।’ 

আচ্ছা, খাদ্যরসিক হুমায়ূন পাঠকরা এবার বলুন তো, ভেড়ার মাংসকে সজারুর কাঁটা দিয়ে কেঁচার কথা কোন উপন্যাসে লেখা আছে? বা ‘শিং মাছের ডিমের সঙ্গে সামান্য মশলা দেবেন। কাঁচামরিচ লাগবে। পিঁয়াজ দেবেন না। কলাপাতা দিয়ে ডিম মুড়িয়ে ভাতের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। মনে থাকবে তো?’ রেসিপিটি কোন উপন্যাসের? অথবা ‘আস্ত ময়ূর পশম/পেখম না ফেলেই রান্না করে টেবিলে এমন ভাবে সাজাতে হবে যেন মনে হয় ময়ূরটি এখনো জীবিত। তারপর ছুড়ি দিয়ে কেটে কেটে খেতে হবে’... এটি? 

বলতে না পারার আনন্দটাই বেশি... এই তথ্য খোঁজার জন্য যদি আপনি আবারও হুমায়ূনের বইপত্র ঘাটতে গিয়ে আবারও কোনো এক নিলু-বিলু-আনিস-বাদলের গল্পে তন্ময় হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারেন, ক্ষতি কী!

১৪৩১৮ পঠিত ... ২২:১২, নভেম্বর ১৩, ২০১৯

Top