বৃষ্টিস্নাত দিনে টিএসসিতে এক কপোত কপোতীর চুম্বনের দৃশ্য দেখে সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে বললে খুব একটা ভুল হবে না। অনেকেই ভালোবাসার উন্মুক্ত হওয়াকে সমর্থন জানালেও সিংহভাগ মানুষ এই ঘটনার ফলে সমাজ ও সংস্কৃতির অধঃপতন থেকে শুরু করে কীভাবে তা আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি প্রেক্ষিতে ধ্বস নামাবে তা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া সাংবিধানিকভাবে কতটুকু গুরুতর অপরাধ, তা সম্পর্কে বিতর্কিত মতামত থাকলেও অন্যদিকে বিভিন্ন সত্যিকারের দন্ডনীয় অপরাধ আমাদের চোখ কীভাবে এড়িয়ে চলে যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১# প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ
প্রকাশ্যে চুম্বনে পরিবেশ কিংবা জনসাধারণের মনে কতটুকু ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকলেও প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ যে অশ্লীল এবং অস্বাস্থ্যকর একটি বিষয়, তা নিয়ে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করবেন না। অথচ ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’র শহরে মিনিট দশেক হাঁটলেই শ’খানেক স্থানে প্রকাশ্য মুত্রত্যাগের নমুনা দেখা যায়। কিন্তু, ‘বাংলাদেশে তো এসব হতেই পারে’ অজুহাতে এ বিষয়ে কেউ তেমন গা করে না।
২# ইভ টিজিং ও শ্লীলতাহানি
‘বাংলাদেশে হতেই পারে’ দোহাইয়ে পার পেয়ে যায় ইভ টিজিং ইস্যু। গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল সবখানেই ইভ টিজিং ও যৌন হয়রানি যথেষ্ট প্রকাশ্যেই হচ্ছে। এমনকি ভীড়, সমাবেশ কিংবা উৎসবেও যৌন হয়রানি যেন ডাল ভাতের মতো একটা বিষয়। প্রকাশ্য চুমুতে সমালোচনার ঝড় উঠলেও, অগণিত মানুষের সামনেও কোন নারীকে লাঞ্চিত হতে দেখে ‘স্পিকটি নট’ মুডে চলে যান সবাই।
৩# প্রকাশ্যে ঘুষ
‘ঘুষ দেয়া ও নেয়া, দুটিই গুরুতর অপরাধ’ এই বুলিটি আমরা নানা স্থানে ও নানা মাধ্যম থেকে জানতে পেলেও এই ‘গুরুতর’ অপরাধের উল্লেখযোগ্য শাস্তির নমুনা দেখা তো দূরে থাক, এটা যে আমাদের সিস্টেমেরই একটা অংশ- তা আমরা অনেকটা বিনা প্রতিবাদেই মেনে নিয়েছি। শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ প্রায় সব স্তরেই এই ব্যাপারটি প্রচলিত। রাস্তায় রং সাইডে যেতে ট্রাফিক পুলিশের হাতে পাঁচ টাকার নোট গুঁজে দেওয়ার দৃশ্য আমাদের নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপারেই পরিণত হয়েছে।
৪# আত্মসাৎ
দেশের সাধারণ মানুষেরা মাথার উপর ছাদ আর দু বেলা খেতে পেলেই অনেকটা সুখী থাকলেও, কিছু অসাধারণ মানুষের তাতে চলে না। সংবাদে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনা মাঝে মধ্যেই খবরে দেখতে পেলে আমরা ‘এত টাকা মেরে দিল! ওহ আচ্ছা!’ এ ধরনের ধারণা ৩০ সেকেন্ড মাথায় ঘুরলেও দৈনন্দিন ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়ি। প্রকাশ্যে টাকা, স্বর্ণ, কয়লা,গ্যাস ইত্যাদি গায়েব হয়ে যাবার পরেও এর বিচারে আমাদের খুব বেশি মাথাব্যাথা দেখা যায় না।
৫# ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল
গাড়ির সামনে কাঁচের বিকল্প হিসেবে বড় প্লাস্টিক শিট টানিয়ে বাঁকানো বডির গাড়ি বিপুল বিক্রমে চলচে রাস্তা ধরে। তাও ঈদের মতো ব্যস্ত আর দূর্ঘটনাপ্রবণ সময়ে। তা দেখে প্রতিবাদ করা দূরের কথা, সর্বোচ্চ কিছু রসিকতা আর তা শেয়ার করতে পারি। প্রতি বছর দুই ঈদে বাড়ি ফেরত মানুষদের অনেকেই যে রাস্তাতেই মৃত্যুবরণ করছে, তার যে কোন সমাধান কিংবা সংশ্লিষ্টদের যে বিচার হতে পারে, তা আমরা ধারণাই করতে পারি না।
৬# প্রকাশ্যে মাদক সেবন
শহরের বেশ কিছু রাস্তা আর আইল্যান্ডে মাদকাসক্তদের মাদক সেবন দেখে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে, আমরা তার কোন প্রতিবাদ না করে চোখ ফিরিয়ে নেই অন্যদিকে। প্রকাশ্যে চুমুতে মাদকসেবনের চেয়ে ক্ষতি বেশি কি না তা বলা যায় না।
৭# জোর যার, বাঙাল মুলুক তার
অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের উপর ক্ষমতাসীনদের হামলা-মামলা খুবই নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি দাবি আদায়ের আন্দোলনেই নেমে এসে প্রকাশ্য হামলা। কখনো পুলিশ, কখনো কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন। প্রকাশ্য হামলার এ সব ছবি, ভিডিও প্রকাশিত হলেও তাতে দৃশ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি।
৮# সর্বত্র ডাস্টবিন বিরাজ করুক
ময়লা আবর্জনা যখন তখন যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া যেন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। পুরো দেশটাই যেন আস্ত একটা ভাগাড়। ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকত যেখানেই থাকি না কেন চিপস, চকোলেট, কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে প্যাকেট কিংবা বোতলটা আমরা আপন মনে ফেলে দিই যেখানে সেখানে। এ কাজটি প্রকাশ্যে করতেও আমাদের মাঝে কোন সংকোচ, নীতি-নৈতিকতা কাজ করে না।