আমি মারা গেছি ২০১১ সালের ১০ জুন, বেলা ৩ টা ৪৬ মিনিটে। আকাশ ছিলো অন্ধকার, বৃষ্টি হবে হবে ভাব।
মারা যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত শিওর ছিলাম না সত্যিই মরবো কি-না। খুব ভয়ে ছিলাম।
মরার পর দেখি জন লেননের কল্পনার মতো অবস্থা। এখানে আমরা খাই, দাই, চিল করি। কারো মধ্যে ভেদাভেদ নেই। ভয় পাবার কারণ নেই। চাকরি বাকরি, টাকা-পয়সার চাপ, প্রতিদিন বাজার করার ঝামেলা থেকে আমরা মুক্ত। তবে এখানের সমস্যাও আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো এখানে আমাদের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। মোবাইল আছে, কিন্তু ওয়াইফাই নেই। আমাদের নিরানন্দ জীবনে ৫ বছর পরপর আনন্দের ভান্ডার নিয়ে আসে নির্বাচন। নির্বাচন আসার কয়েক মাস আগে থেকে এখানে উৎসব উৎসব একটা ব্যাপার চলে আসে৷ কে কাকে ভোট দিবে, কে যোগ্যপ্রার্থী এসব নিয়ে চায়ের কাপে ওঠে ঝড়। যদিও দিনশেষে আমাদের মত অনুযায়ী ভোট দেওয়া হয় না— তবু ভোট দিচ্ছি এই কম কোথায়?
ভোট দেওয়ার ইচ্ছায় কেউ যদি মারা যেতে চান, তাহলে জেনে রাখা জরুরি যে, মৃত মানুষরাও চাইলেই ভোট দিতে পারে—এমন নয়। এখানেও সিরিয়াল আছে, লবিং আছে। সিনিয়রিটি মেইনটেইন করতে হয়। যেমন জহির রায়হান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হুমায়ুন আহমেদ, কাজী নজরুলসহ বিখ্যাত মানুষেরা প্রতি নির্বাচনেই ভোট দেন। আমাদের মতো আমজনতারা তিমি মাছের মতো হাঁ করে থাকলেও সেই সুযোগ হয় না। সবকিছু হবে সিরিয়াল অনুযায়ী। এই নির্বাচনে আমার ভোট দেওয়ার কথা। ২০১০-১৪ সেশনে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তারা এই নির্বাচনে ভোট দিবে। এর পরের নির্বাচনে ভোট দিবে ২০১৫-১৯ সালের মধ্যে যারা মারা গিয়েছে তারা। সবকিছুরই একটা শৃঙ্খলা আছে, সেই শৃঙ্খলা আমরা ভঙ্গ করি না৷
গতবারও আশায় ছিলাম ভোট দিবো, জীবিত অবস্থায় যেহেতু দিতে পারিনি! কিন্তু পারলাম না। ভোটকেন্দ্রে যেয়ে শুনি, আমার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আমি চিৎকার চেঁচামেচি করি। মরা মানুষের ভোট আবার কে দিয়ে দিবে? পরে জানতে পারি আমাদের বন্ধু সেলিম রেজা এই কাজ করছে। জীবদ্দশায় সে কোনোদিন নির্বাচন দেখেনি। উত্তেজনায় সেবার ডাবল ভোট দিয়ে দিয়েছে। তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।
ভোটের আগের দিন আমাদের জন্য ইদ। মাঝরাতের মধ্যে মোটামুটি সবাই রেডি হয়ে থাকে। গরম পানি-বডি শাওয়ার দিয়ে গা মেজে মেজে গোসল করে সবাই। এরপর গায়ে সুগন্ধী, সাদা চাদর জড়িয়ে রওনা দেয় কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে অনেকের পরিবারের লোকেদের সাথে দেখা হয়ে যায়। কারণ তারাও জানে মৃত অবস্থায় মানুষেরা ভোট দিতে আশে। একবার যদি দেখা হয়ে যায়! এই আশায় তারা ভোটের আগের দিন সারারাত ঘুরঘুর করে কেন্দ্রের আশেপাশে। আমরা লাইনে দাঁড়াই৷ অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে ব্যালটে সীল দেই। গোপনীয়তা বজায় রাখলেও আমরা জানি সবাই কাকে ভোট দিচ্ছে।
আবার চলে এসেছে নির্বাচন। আমাদের চারদিকে উৎসবের আমেজ। ৭ তারিখ দিবাগত রাতে আমরা নেমে আসবো পৃথিবীর বুকে, ভেজা ঘাস পেরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যালটের বুকে সাঁটিয়ে দিবো সীল, রচিত হবে আগামী পাঁচ বছরের ইউলজি...