ফার্মগেটের সেই রেস্টুরেন্টটা

৩৬৫ পঠিত ... ১৭:১৪, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩

Farmgater-resturent

রেস্টুরেন্টের দরজায় এক বৃদ্ধ কটমট চোখে তাকিয়ে।

এমনভাবেই দাঁড়িয়ে আছে যে তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সকালের নাস্তা হবে?’

জিজ্ঞেস করার কোন কারণ নেই। চোখের সামনেই তাওয়ায় পরোটা সেঁকছে এক ছোকরা। কিন্তু কিছু একটা তো বলতে হবে, না হলে ঐ ব্যাটা দরজা থেকে সরবে কেন?

বৃদ্ধ ঐভাবেই চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সিট খালি নাই!’

এমন তো কোথাও দেখিনি! এ কি মেস নাকি যে সিট খালি না থাকলে এই মাসে আর খালি হবে না? কিছুক্ষণের মধ্যেই তো হবে। নাকি কোন অফিসের ক্যান্টিন? অন্য কারো ঢোকা নিষেধ? ভাব-ভঙ্গিতে তো কমার্শিয়াল পরোটা-ভাত খাবার রেস্টুরেন্টই মনে হয়!

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে সেদিন পাশের রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে অফিসে ঢুকতে হবে। কেয়ামত হয়ে গেলেও সকালের নাস্তা বাদ দেয়ার বান্দা আমি না।

আরেকদিন অফিসের পথে হাঁটছি। আবার চোখে পড়লো সেই হোটেলটা। ঠিক সেদিনের মতোই বৃদ্ধ চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে। সেদিনের মতো নাকি আজকেও সিট খালি নেই!

কী রে বাবা! খুব বিখ্যাত হোটেল নাকি? নাকি খুব মজার নাস্তা? এমন হলে তো আমার জানার কথা! ব্যাপারটা কী এই রেস্টুরেন্টের?

কথায় আছে, অকাজের যারা- তারা খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে। আমি যে অকাজের, এই ব্যাপারে বন্ধু-বান্ধব, অফিস কলিগ, প্রিয়তমা বউ কারোর কোন সন্দেহ নেই। আমার নিজেরও নেই। অফিসের কাজের গন্ধমাদন, সাংসারিক হ্যাপায় আমি নির্বিকার থাকি। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের রহস্য উদঘাটনের জন্য মাথায় রোখ চেপে গেলো।

সকাল সকাল অফিস যাওয়ার পথে প্রায়ই রেস্টুরেন্টটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কয়েকদিন দাঁড়িয়ে থাকার পর সুফল মিললো। দুইজন বৃদ্ধ লোক রেস্টুরেন্টটা থেকে গল্প করতে করতে বেরুচ্ছেন। সাথে সাথেই আমি ঐ কটমট করে তাকিয়ে থাকা বৃদ্ধ দারোয়ানকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। আজকে 'সিট খালি নাই' বলার উপায় নেই, চোখের সামনে দুইজন বেরিয়েছে। কিন্তু অন্যকিছু বলে যদি আটকে দেয়? কথা বলে অনুমতি নেয়ার রিস্কে যাবার কী দরকার।

এ ব্বাবা... কোন ওল্ড হোমে ঢুকে পড়লাম নাকি? ক্যাশে বসে আছে শুভ্র দাড়ির ম্যানেজার। সার্ভ করছে তিন প্রৌঢ়। আর সামনের সাত আটটা টেবিলে গিজগিজ করছে অগণিত বৃদ্ধের মুখ!

পরিবেশ দেখে আমি কেমন যেন হকচকিয়ে গেলাম। ওয়েটারের দাঁড়িতে কাচাপাকা রঙের খেলা। আর সবার সাথে হাসি হাসি মুখে কথা বললেও আমার সামনে এসে সেই দারোয়ানের মতোই কটমট চোখে বললো- কী চাই?

এ কোন ধরনের ভাষা? বলতে পারতো যে- কী খেতে চাই!

আমি গায়ে মাখলাম না। এই রেস্টুরেন্টে একটা কিন্তু অবশ্যই আছে। অর্ডার দিলাম পরোটার। এইখানে সব পরোটাই নাকি তেল ছাড়া! সাথে ডালভাজি, ডিমের ভাজা।

এইবার টেবিলের নিচের দিকে চোখ যেতেই পুরো ব্যাপারটা আমার সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এনাদের সবার পায়ে কেডস পরা! তারমানে ডায়াবেটিসের পেশেন্ট। সকালবেলায় হাঁটতে বের হয়ে একটা সময়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়েন তাদের এই গোপন আস্তানায়! বাসায় নিশ্চয়ই তাঁদের ডায়েটে কড়াকড়ি! এইখানে কে বাঁধা দেবে? যত ইচ্ছে অর্ডার দাও আর খাও।

এলো তেলছাড়া পরোটা। সাথে ডালভাজিতেও দেখলাম তেলের ব্যবহার নামেমাত্র। আশেপাশের টেবিলে চা-ও দেখলাম দেয়া হচ্ছে চিনিছাড়া। লবনদানীর বদলে টেবিলে চিনির বাটি দেয়া। যার ইচ্ছা সে নিয়ে খাচ্ছে।

এই রেস্টুরেন্টটা নিয়ে কি একটা ফিচার লিখবো? বা খাই-দাই ডট কমের একটা শো? মুহূর্তেই চিন্তাটা নাকচ করে দিলাম। কারো গোপন আস্তানা ফাঁস করার কোন অধিকার আমার নেই। এই বৃদ্ধদের অভিশাপেই আমাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হতে পারে!

অবাক কাণ্ড! চিনিতে চা না খেলেও অনেকে জিলিপির অর্ডার করছেন। ওয়েটাররা সেই জিনিস বাইরে থেকে কিনে নিয়েও আসছেন! বৃদ্ধদের অনেকেই গরম গরম জিলিপি ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে খাচ্ছেন। মুখে অপরাধবোধ ফুটে থাকা একটা হাসি।

আমার ঠিক সামনের টেবিলেই এক বয়ষ্ক লোক খাচ্ছেন। আমার দিকে পিঠ করে বসা। কী আশ্চর্য্! বসার ভঙ্গিটা ঠিক আব্বার মতো! আমার শিঁড়দাড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো! এটা আব্বাই তো! এই তো ঘাড়খানা নিচু করে ডানহাতটা একটু সামনে টেনে পরোটা আর জিলিপি খাচ্ছেন!

আমি উঠে সামনে এগোবো তাঁর দিকে, এই সময়ে একটা নাটক হলো। আমার কাছাকাছি বয়সী এক লোক ঢুকলো রেস্টুরেন্টে। আমার মতোই বেমানান। ঐ দারোয়ানকে ঠেলেই ঢুকলো। তারপর আমার সামনের টেবিলের বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বললো- বাবা, আবার আপনে এইখানে জিলাপি খাইতেছেন? আবার? উঠেন, আপনার আর হাঁটোন লাগতো না!

এরইমধ্যে আমার ডিমভাজা চলে এসেছে। ভাজার শব্দে ডিম এখনও মুচমুচ শব্দ করছে। হঠাৎ মনে হলো, কত জনমের পূণ্য দিয়ে ঐ ছেলের ভাগ্য আমার হবে? কত জনমের? কত জনমের?

ওয়েটার... এই ওয়েটার...

নিজের গলার কণ্ঠস্বরে আমি নিজেই চমকে উঠলাম। আর এই বয়ষ্ক লোককে আমি ওয়েটারই বা ডাকছি কেন?

বৃদ্ধ ওয়েটার কটমট করে তাকিয়ে বললো- কন।

- বিল কত?

সে আমার আধাখানা খাওয়া পরোটা আর অভুক্ত ডালভাজি, ডিমের দিকে তাকিয়ে বললো- স্যার কী হইছে, আপনে খাইবেন না?

- বিল কত?

- ছাপ্পান্ন টাকা।

আমি মানিব্যাগ বের করে একশ টাকার একটা নোট রেখে বেরিয়ে এলাম। ঢাকার বুকে এই একটা রেস্টুরেন্টে আমার পা এই জীবনে আর পড়বে না।

কখনোই না!

৩৬৫ পঠিত ... ১৭:১৪, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩

Top