আশাপূর্ণা দেবী। মেয়ের আশা পূর্ণ করায় নাম হল আশাপূর্ণা। কিন্তু অমন সুন্দর নামের পেছনের গল্পটা কিন্তু সুন্দর নয়।
অনেকগুলো কন্যা সন্তান জন্মানোর পর ঘরে আবারো কন্যা সন্তান আসায় ঠাকুমা বলেছিলেন, ‘মেয়ের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আর মেয়ে নয়!’ তাই থেকে অমন নাম। জন্মের পরেই অবহেলা, তৎকালীন সময়ে সমাজে নারীদের অবস্থান, তাদের পদে পদে হেনস্থা হতে দেখেছেন নিজের চোখে। চৌদ্দ বছর বয়সে রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হয়ে যায়, তবুও কী তার লেখালেখি আটকানো গেছে? বাংলা সাহিত্যের নতুন মুকুল হয়ে ফুটেছিলেন তিনি, লেখক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’ দিয়ে।
কিশোরী আশাপূর্ণা একবার রবীন্দ্রনাথকে হঠাৎ চিঠি লিখে ফেলেন। কবি সেই চিঠি পড়ে বুঝেছিলেন, আগামীদিনে বাংলা সাহিত্যে এক সন্ধ্যাতারা ফুটতে চলেছে। মুগ্ধ হয়ে চিঠির জবাবে কবি বলেছিলেন, ‘আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।’
আশাপূর্ণা দেবীর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত কথামালা দেওয়া হল পাঠকের জন্য।
১# চোখকে যদি মনের দর্পন বলা হয়, তো চিঠিকে বলা যেতে পারে মনের ফটোগ্রাফ। মনের এক একটি মেজাজ, এক একটি অনুভবের মুহূর্ত, এক একটি অবস্থা ধরা পড়ে বন্দী হয়ে থাকে চিঠিপত্রের পৃষ্ঠায়। আর এই টুকরো মুহূর্তগুলিই তো মানুষের প্রকৃত রুপকে ফুটিয়ে তোলে।
২# যাকে সামনে সমীহ করতে বাধ্য হতে হয়, তাকে আড়ালে নিন্দে করতে না পেলে বাঁচবে কেমন করে মানুষ?
৩# এতো আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো এতো অন্ধকারে কেন?
৪# সুখের বদলে সম্মান বিকাইয়া দেওয়া যায় না। সুখ বিদায় হোক — সম্মান থাক জীবনে।
৫# মলাটের চেহারা কতোটা চিত্তাকর্ষক করতে পারলে বই কতোখানি চিত্তাকর্ষক হতে পারে, সেই চিন্তায় মাথা ঘামাচ্ছি আমরা।
অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়ে তো এখন মলাটেরই যুগ চলছে।
মানুষ তো শুধু জিনিসের ওপরেই বাহারের মলাট দিচ্ছে না, জীবনের ওপরেও মলাট দিচ্ছে। যার যা মূল্য ধার্য হচ্ছে সে ওই মলাটের বাহার দেখে।
৬# উঁচুতে উঠতে হলে কত নীচুতে নামতে হয়। কিন্তু সেটা সত্যি উঁচু নয় বলেই তো। অথচ এই পৃথিবী ওইটাকেই সত্যি উঁচু ভেবে অবিরত নীচে নেমে চলেছে।
৭# নারী ছলনাময়ী, নারী জন্ম অভিনেত্রী। কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে? বিভ্রান্ত করবার জন্যে? বাঁচবার জন্যে নয়? আশ্রয় দেবার জন্যে নয়?
৮# মেয়েমানুষ যতক্ষণ না নিজের স্বার্থ কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়, ততক্ষণ তাকে কে চিনতে পারে।
৯# সংসার মানুষকে চেপে পিষে ফেলে, বিশেষ করে মেয়ে মানুষকে। তার ভিতরকার যা কিছু মাধুর্য, যা কিছু কোমলতা, যা কিছু ছাঁচ, সব যেন ঘষে ক্ষইয়ে ভোঁতা করে শুকিয়ে চারটি ধুলোবালি করে ছেড়ে দেয়।
১০# আপাতদৃষ্টিতে যাকে সুখী মনে হয় সে হয়তো আদৌ সুখী নয়, আবার যাকে নেহাৎ দুঃখী মনে হয় যে সত্যিকারের দুঃখী নয়। বাইরের চেহারা আর ভেতরের চেহারা দুটোর মধ্যে হয়তো আকাশ পাতাল তফাৎ।
১১# মেয়েমানুষ যতই মুখ্যু হোক তাকে ঠকানো বড় শক্ত। সে সব জেনেশুনেও চুপ করে থাকে, পাছে তার পাখির বাসাটি ভেঙে যায়।
১২# মন রেখে রেখে কী কখনো কারো ‘মন রাখা’ যায়? যায় না। শুধু সেই মনের দাবী আর প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেওয়া হয় মাত্র।
১৩# কথা’ই তো ‘জীব’ জগৎ থেকে মানুষ জাতটাকে পৃথক করেছে, তাকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, উন্মত্ত নিয়ে চলেছে। কথাই সভ্যতার বাহন, সংস্কৃতির বাহন। কথা আর তখন ‘কথা’ মাত্র না থেকে হয়ে উঠেছে ‘কথা শিল্প।’
কথাই ‘বাণী’, কথাই ‘ব্রহ্ম’। কথার মধ্যেই মানুষের অস্তিত্ব, কথার মধ্য দিয়েই মানব মনের মুক্তি। সে মুক্তি স্রষ্টারও, ভোক্তারও।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন