সাধারণত কারো জন্মদিন বলার ক্ষেত্রে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। কেউ যখন জিজ্ঞেস করে ‘তোমার জন্মদিন কবে?’ তখন মার্চ, সেপ্টেম্বর কিংবা জানুয়ারির হিসেবটাই জানানো হয়।
তবে একজনের ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্ন। তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবি ঠাকুরের জন্মদিন বললেই এক কথায় সবার মাথায় আসে পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর জন্মদিবস নিয়ে গানে গানে বলে গেছেন,
‘উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।।’
এ দেশের মানুষের জীবনে যতই আকাশসংস্কৃতির প্রভাব পড়ুক, রবি ঠাকুরের নামে সবাই এক্কেবারে ষোলআনা বাঙালি, ক্ষেত্র বিশেষে খানিকটা মৌলবাদীও। তাই প্রতি বছর ঘটা করে তার জন্মদিন পালন করা হয় পঁচিশে বৈশাখ।
টিভিতে তাঁর গল্পের বেশ কিছু রিমেক দেখা যায়; কিছু ভুল সুরের রবীন্দ্র সঙ্গীতানুষ্ঠান শোনা যায়; পূজা পর্বের গানগুলোকে প্রেমের গান হিসেবে উপস্থাপন করে বেশ একটা জন্মদিন উদযাপন করা হয়। কিন্তু যে দিনে এত আনন্দ উচ্ছ্বাস উদযাপন সেই দিনটা কি আদৌ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন?
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৪তম সন্তান শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেদিন জন্ম হয়েছিল দিনটি ১৮৬১ সালের ৭ মে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এদেশে বছরের পর বছর তাঁর জন্মদিন পালিত হয়ে আসছে ৮ মে! কিন্তু কেন?
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে হয়। ফলে সৌরবছরের সাথে সৃষ্ট গোলমাল সমাধান করার জন্যে প্রতি চার বছর পর ‘লিপইয়ার’ অর্থাৎ অধিবর্ষের বছরে ২৯ দিনে ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়। বাংলা পঞ্জিকায় এমন কোন ব্যবস্থা নেই। যার ফলে বাংলা তারিখের সাথে গ্রেগরিয়ান তারিখের কিছু হেরফের ঘটত যেমন পঁচিশে বৈশাখ কখনও ৭ মে আবার কখনও ৮ মে পড়ত।
তবে সমস্যা হলো, ১৯৫২ সালে যখন বিশ্বখ্যাত জ্যোতিপদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহা বাংলা পঞ্জিকার আমূল সংস্কার করলেন। কেননা এই পহেলা বৈশাখ কখনও তেরোই এপ্রিল কখনও বা চৌদ্দ কখনও আবার ১৫ তারিখে পড়তো এবং বিষয়টা বিব্রতকর! তাই তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন ১৪ই এপ্রিলই পহেলা বৈশাখ পালিত হবে। এপার বাংলা থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই সিদ্ধান্তে সহমত জানালেন।
কিন্তু তৎকালীন প্রচীনপন্থীরা এই সংস্কার মেনে না নিয়ে ১৫ই এপ্রিলকেই পহেলা বৈশাখ হিসাবে গ্রহণ করলো। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসক এরশাদ এই দেশে ১৪ই এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ হিসাবে চূড়ান্ত করলেন। তবে ওপারের পহেলা বৈশাখ রয়ে গেল ১৫ই এপ্রিলেই।
এর ফলে এপার বাংলায় বেচারা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ৭ মে থেকে গড়িয়ে পড়ল ৮ মে-তে, আর ওপার বাংলায় সেই জন্মদিন হাই জাম্প দিয়ে চলে গেল ৯ মে-তে।
যদিও আমরা সকলেই জানি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির হিসেবটাই পঞ্জিকার শুদ্ধতম হিসাব, তবুও গুরুদেবের ক্ষেত্রে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবোধ তুলনামূলক বেশি। ফলে উনি ৭ই মে জন্মগ্রহণ করে থাকলেও তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখই পালন করতে হবে। হোক তাতে এক আধ দিন পরে জন্মজয়ন্তি উদযাপন কিন্তু তাতে বাঙালিত্বটা ঠিক থাকছে তো। দিন শেষে ঐ দুই একদিনই যে বাঙালি ‘বাঙালি’সাজে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন